'মা লাইন কেটে দিয়েছে'

তাসনিম মাহিরা তুবার বয়স মাত্র চার বছর। ছোট খেলনা মুঠোফোন কানের কাছে নিয়ে সে মাকে ফোন করে। কিছুক্ষণ পর রাগ করে খেলনা মুঠোফোন ফেলে দিয়ে বলে, ‘মা কথা বলে না। লাইন কেটে দিয়েছে।’ একটু পরেই দেখা গেল, মায়ের হিল জুতা পায়ে দিয়ে সারা ঘরে হাঁটছে সে। পরিবারের সদস্যরা যখন পারিবারিক অ্যালবাম নিয়ে বসেন, সেখান থেকে ঠিকই মায়ের ছবি বের করে অন্যদের দেখিয়ে বলে, ‘এই যে এইটা আমার মা।’ ২২ দিন হয়ে গেল, মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি তার।

১১ বছর বয়সী তাহসিন আল মাহির রাতে স্বপ্ন দেখে স্কুল থেকে ফিরলে মা জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়েছেন। তাই সকালে চোখ মেলেই শুরু হয় মায়ের জন্য কান্না। মাহির বুঝতে পারে, তার মা তাসলিমা বেগম আর ফিরবেন না। ছোট্ট তুবা এখনো তা বুঝতে পারে না। কিন্তু তুবার ভেতরের যে যন্ত্রণা, তা অন্য কাউকে বোঝাতেও পারছে না। তাই তুবার খেলা, বায়না, অযথা কান্নাকাটি, জেদ সবই মেনে নিচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।

রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ২০ জুলাই ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগমকে হত্যা করা হয়। মাহির আর তুবাকে স্কুলে ভর্তির জন্য খোঁজ নিতে গিয়ে স্কুলের ভেতর গণপিটুনিতে নিহত হন তিনি।

মাহির আর তুবা বর্তমানে আছে তাদের নানির বাসায়। গতকাল শনিবার রাজধানীর মহাখালীর বাসাটিতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে ঈদের কোনো আমেজ নেই। তুবা ও মাহিরের জন্য নতুন জামা কেনা হয়েছে। ওদের কথা ভেবেই গরুও কেনা হবে। কিন্তু ঈদের আনন্দ বলতে যা বোঝায়, তা করতে পারবেন না কেউ।

মা তাসলিমা বেগমের ছবি দেখাচ্ছে ছোট্ট তুবা। শিশুটির মা রাজধানীর বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত হন। গতকাল মহাখালীতে শিশুটির নানির বাসায়।  ছবি: প্রথম আলো
মা তাসলিমা বেগমের ছবি দেখাচ্ছে ছোট্ট তুবা। শিশুটির মা রাজধানীর বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত হন। গতকাল মহাখালীতে শিশুটির নানির বাসায়। ছবি: প্রথম আলো

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর দুই বছর ধরে মাহির মা ও বোনের কাছ থেকে আলাদা থেকেছে। বাবার সঙ্গে থাকত মাহির। বাবা তাকে গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি করে দেন। তুবা আর তুবার মা মহাখালীর বাসাটিতে থাকতেন। ঢাকায় এসে বোনের সঙ্গে মাহির খেলে, তবে কিছুটা জড়তা আছে। বড়দের আলোচনা সে সবই বুঝতে পারে, তাই বেশির ভাগ সময় চুপ করে থাকে।

তুবা ও মাহির রাতে তাদের খালা নাজমুন নাহারের সঙ্গে থাকছে। মায়ের বাসার পাশেই নাজমুন নাহারের বাসা। নাজমুন নাহারের মা শোকে বর্তমানে শয্যাশায়ী। পরিবারের সদস্যদের কাছে তাসলিমা বেগমের আদরের নাম ছিল ‘রেণু’। রেণুই মূলত মাকে দেখাশোনা করতেন।

নাজমুন নাহার বললেন, ‘তুবা আর মাহির আমাকে মামণি আর আমার স্বামীকে বাবা ডাকে। অনেক রাত পর্যন্ত তুবা ঘুমায় না। রাতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারি, ও মাকে খুঁজছে। কিন্তু কিছুই বলতে পারি না ওকে। মাহিরকে একটু একটু করে পড়াতে বসাচ্ছি। দুজনকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে।’

তাসলিমা বেগমের মা, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা একমাত্র ভাই ও অন্য চার বোন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাসলিমা বেগমের দুই ছেলেমেয়েকে তাঁদের কাছে রাখবেন, পড়াশোনা করাবেন। এই দুই শিশুর বাবাকেও তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাসলিমা জীবিত থাকা অবস্থায় তুবার বাবা তুবার জন্য সামান্য হাতখরচ দিতেন। তাসলিমা বেগম আগে চাকরি করতেন, তবে ছেলেমেয়ের দেখাশোনার জন্য স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরে মা, ভাই ও বোনেরা তাসলিমা ও তুবার বিভিন্ন খরচ দিতেন।

তাসলিমা বেগম
তাসলিমা বেগম

তাসলিমা বেগমের মৃত্যুর পর তাঁর ভাগনে সৈয়দ নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা করেন। তিনি বললেন, তাসলিমা বেগমের মৃত্যুর পর পুলিশ তৎপর হলেও তাঁকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়নি। প্রাথমিকভাবে মামলা যেভাবে চলছিল, সেই সময়ের বিভিন্ন ভিডিও দেখে মনে হচ্ছে, মূল আসামিদের এখন পর্যন্ত ধরা হয়নি। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কেউ একজন ভেতর থেকে তালা খুলে দিলে জনগণ ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়। অথচ এত দিন বলা হচ্ছিল, তালা ভেঙে জনগণ ভেতরে ঢুকেছিল।

সৈয়দ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ ঘটনায় যাতে ন্যায়বিচার পাই, তা নিশ্চিত করার দাবি জানাব। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস বা কোনো ধরনের সহায়তা পায়নি এই দুই শিশু।’ তাসলিমা বেগম হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামিসহ এখন পর্যন্ত মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ঈদের প্রসঙ্গে আসতেই সৈয়দ নাসির উদ্দিন বললেন, ‘তিন দিন আগে থেকে রেণু খালার ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। নিজে হাতে মেহেদি দিতেন, তুবাকে দিয়ে দিতেন। হরেক পদের রান্না করতেন। এবার সেসব কিছু হবে না।’