মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হলো না

জোবেদা খানম
জোবেদা খানম

সাদা কাফনে মোড়ানো মায়ের নিথর দেহটা নিজেই শুইয়ে দিল কবরে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ছিটিয়ে দিল মাটিও। এবার ফেরার পালা। কিন্তু যে মা কখনো তাকে রেখে কোথাও থাকেননি, সেই মাকে একা রেখে আসতে যে খুব কষ্ট হচ্ছিল শফিকুর রাজীবের। মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে বারবার চোখ মুছছিল সে। আকাশ ভেঙে তখন পড়ছিল বৃষ্টি।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র শফিকুর রাজীব, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া স্কুলশিক্ষক জোবেদা খানমের ছেলে। ৩ আগস্ট বিকেলে নগরের শুলকবহর এলাকায় পেছন থেকে কাভার্ড ভ্যান ধাক্কা দিলে টেম্পো উল্টে নিহত হন রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমেনা বেগম। গুরুতর আহত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জোবেদা খানম ও সহকারী শিক্ষক সোমা ঘোষ। ছয় দিন ধরে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত শুক্রবার রাতে মৃত্যুর কাছে হার মানেন জোবেদা।

গতকাল শনিবার ভোরে জোবেদা খানমের লাশ রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটার বাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে ভিড় জমান বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক আর আত্মীয়স্বজন। তাঁদের সবার চোখেমুখে ছিল স্বজন হারানোর শোক। জানাজা শেষে সকাল সাড়ে ১০টায় দাদির কবরের পাশে দাফন করা হয় তাঁকে।

জোবেদা খানমের নিকটাত্মীয় মোহাম্মদ সাইমুন শাহরিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, মায়ের সঙ্গে শেষ কথাও হলো না শফিকুর রাজীব ও আদিবা আরেফিনের। ঈদের আগেই মাকে হারাল তারা। আদিবা মা ছাড়া কিছুই বোঝে না। এমনকি মায়ের হাতে ছাড়া কখনো নিজ হাতে ভাতও খেত না। এখন মা-হারা এই শিশুটি কীভাবে সামনের এতটা সময় পার করবে, তা নিয়েই চিন্তিত সবাই। স্বজনেরা জানান, জোবেদা খানমের মা সুরাইয়া বেগম এখন হজ পালনে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। অসুস্থ হয়ে পড়বেন, এই আশঙ্কায় তাঁকে শোনানো হয়নি মেয়ের মৃত্যুর কথা।

দুই সহকর্মীকে হারিয়ে রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সড়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, দিনের বেলায় নগরে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান নিষিদ্ধ হলেও চলছে। নিয়ন্ত্রণহীন কাভার্ড ভ্যানের কারণেই দুই সহকর্মীকে তাঁদের হারাতে হয়েছে। তাঁরা যেসব শিক্ষক নগর থেকে বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে শিক্ষকতা করেন, তাঁদের জন্য আলাদা বাস দেওয়ার দাবি জানান।

সহকর্মী পরিচয় ছাপিয়ে একই দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া আমেনা আর জোবেদার সম্পর্ক ছিল আরও গভীরে প্রোথিত। একসঙ্গে স্কুল, কলেজে পড়েছেন দুজন। তারপর একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেন। এর বাইরেও ঘনিষ্ঠ এই দুই বন্ধুর প্রায় একই বয়সী একটি করে ছেলে ও মেয়ে আছে। তাই পরিচিতরা দুজনকে নিয়ে মজা করে বলতেন, ‘তোমাদের আত্মা দুটো হলেও তা যেন অভিন্ন।’

বলতে গেলে সারা জীবন একই সুতোয় বাঁধা ছিলেন দুই বন্ধু। মৃত্যুও এল একই দুর্ঘটনায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাঙ্গুনিয়ার প্রায় কাছাকাছি দুটো কবরস্থানের মাটির নিচে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন দুই বন্ধু।