ঘুষের তহবিলে জমা পাঁচ কোটি টাকার হদিস নেই

দেশের একমাত্র কয়লাখনি কোম্পানিতে ঘুষ দেওয়ার তহবিলে জমা পড়া পাঁচ কোটি টাকার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। বড়পুকুরিয়া কোল কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ তহবিলের দেখভালকারী দুই কর্মকর্তার নাম তদন্ত প্রতিবেদনে এলেও তাঁদের শাস্তির আওতায় আনেনি খনির তদারকি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা।

কর্মকর্তা–কর্মচারীদের লভ্যাংশ বোনাস (প্রফিট বোনাস) থেকে জনপ্রতি ৪০ হাজার টাকা বিসিএমসিএলের ট্রাস্টি বোর্ড কমিটি রেখে দিচ্ছে—এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গত ৯ জুন বিসিএমসিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয় তদন্ত কমিটি। এতে ঘুষের তহবিল গঠন, সেখানে চাঁদা জমা করা এবং এই টাকার খোঁজ না পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

বিসিএমসিএল সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিতে পেনশন বা অবসরকালীন সুবিধা ছিল না। অবসরকালীন সুবিধা পেতে ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বড়পুকুরিয়া কোল মাইন অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বৈঠক আহ্বান করে। সিদ্ধান্ত হয়, বিসিএমসিল কর্তৃপক্ষকে পেনশন চালুর জন্য তারা অনুরোধ জানাবে। বড়পুকুরিয়া কোল মাইন অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাশেম প্রধানীয়া ও সাধারণ সম্পাদক আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে তহবিল গঠনে বিশেষ কমিটি করা হয়। তখনই সিদ্ধান্ত হয় যে খনির ১৪৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা জমা দেবেন এ তহবিলে। এ খাতে মোট ৪৪ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।

এ ছাড়া পেনশন সুবিধা চালুর জন্য প্রফিট বোনাস থেকে প্রত্যেকে টাকা জমা দেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বিসিএমসিল কর্তৃপক্ষ লভ্যাংশ থেকে কোম্পানির সবাইকে জনপ্রতি ৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা লভ্যাংশ দেয়। এর মধ্যে চাঁদা হিসেবে জনপ্রতি দিতে হয় ৯২ হাজার টাকা। এ ছাড়া ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে প্রফিট বোনাস থেকে জনপ্রতি ৯৬ হাজার, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিশেষ তহবিলে রাখা হয়। ওই তিন বছরে চাদার পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে চার কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে পেনশন চালুর জন্য জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা চাঁদা যোগ করে ঘুষের তহবিলে জমা হয় পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু পেনশন সুবিধা চালু না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই টাকা ফেরত চান। তখনই বিষয়টি প্রকাশ পায়।

>

পেনশন সুবিধা পেতে ঘুষ বাবদ এই তহবিল চালু হয়
সেই সুবিধা মেলেনি, টাকাও ফেরত পাননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
তহবিলের দেখভালকারী দুই কর্মকর্তার নাম তদন্ত প্রতিবেদনে
দুই কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনেনি পেট্রোবাংলা

জানতে চাইলে এ অভিযোগ তদন্তে সাত সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক ও কোম্পানির উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর সিদ্দিকী গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এদিকে ভুক্তেভাগী ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অর্থ কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দিয়েছেন আবুল কাশেম প্রধানীয়া ও মো. আনিসুজ্জামানকে। পেনশন সুবিধা চালু না হলেও এ অর্থ কোন খাতে খরচ হয়েছে তার প্রমাণ পায়নি কমিটি। এ জন্য উচ্চতর কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

ঘুষের বিশেষ তহবিলের দায়িত্বে থাকা দুই কর্মকর্তা আবুল কাশেম প্রধানীয়া ও মো. আনিসুজ্জামানকে কয়লা চুরির অভিযোগে গত বছর অন্যত্র সরিয়ে নেয় পেট্রোবাংলা। গত বছরের জুলাইয়ে খনি থেকে ১৪২ কোটি টাকার কয়লা চুরির ঘটনা
প্রকাশ হলে ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করে খনি কর্তৃপক্ষ। মামলায় তাঁদের নামও ছিল।

ইতিমধ্যে আনিসুজ্জামান অবসরে গেছেন। মহাব্যবস্থাপক হিসেবে পশ্চিমাঞ্চলে কর্মরত আছেন আবুল কাশেম। জানতে চাইলে আবুল কাশেম মুঠোফোনে গত ১৯ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র। আমি কারও কাছ থেকে টাকা নেইনি। কেউ আমাকে কোনো চাঁদা দেয়নি।’

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে গত ২৮ জুলাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি আমার হাতে এসে পৌঁছেনি। এটা পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’