মহাসড়কে বছরে ৮৭ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

.
.

দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক ও বাস–ট্রাক টার্মিনালে চাঁদাবাজি গোপন কিংবা নতুন কিছু নয়। সবই হয় প্রকাশ্যে এবং নিবন্ধিত সংগঠনের নামে। বছরে মহাসড়ক থেকে কত টাকা চাঁদা আদায় হয়, সেই তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে কারও কাছে নেই। তবে হাইওয়ে পুলিশের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে এই চাঁদাবাজি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ২১৫টি সংস্থা ও সংগঠন মহাসড়কে চলাচলকারী ৫৮ হাজার ৭১৯টি যানবাহন থেকে দিনে গড়ে ২৪ লাখ টাকা চাঁদা তুলছে। বছরে সেই টাকার পরিমাণ ৮৭ কোটি টাকা।

এই চাঁদার টাকায় গোপনে পকেট ভারী হয় পুলিশ, পরিবহন মালিক–শ্রমিক সংগঠনের প্রভাবশালী নেতাদের। রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাও এর ভাগ পান। এ নিয়ে তেমন কোনো লুকোছাপাও নেই। পরিবহন শ্রমিক–মালিকদের অনেকেই বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে তাঁরা নাম উদ্ধৃত হয়ে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করে ঝামেলায় পড়তে চাননি।

 ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের মহাসড়কে চাঁদাবাজির তথ্য সংগ্রহ করেছে হাইওয়ে পুলিশ। এর ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তারা। হাইওয়ে পুলিশেরই জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে মহাসড়কে বাস–ট্রাক থেকে তোলা চাঁদার পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি হবে। এর কারণ, শুধু মহাসড়কে আদায় করা চাঁদার হিসাব করেছেন তাঁরা। আঞ্চলিক সড়ক কিংবা জেলা–উপজেলার সড়ককে ওই হিসাবে ধরা হয়নি।

প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নতুন এসেছেন, এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।

মহাসড়কে চাঁদাবাজির তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির সময় হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি ছিলেন আতিকুল ইসলাম। তিনি এখন নৌ পুলিশের ডিআইজি। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। চাঁদাবাজিতে পুলিশের লোকজনের জড়িত থাকার ব্যাপারে তিনি বলেন, কেউ জড়িত থাকতে পারে, তবে অভিযোগ পাওয়ার পরই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

হাইওয়ে পুলিশের প্রশাসনিক প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে ঈদের আগের সপ্তাহে রাজধানীর তিনটি বাস ও তিনটি ট্রাক টার্মিনালে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়া হয়। টার্মিনালগুলোর পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের কাছে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তা উদ্বেগজনক। তাঁরা বলেন, বাসের তুলনায় পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি হচ্ছে বেশি। ঈদের সময় তা বহুগুণ বেড়ে যায়। ট্রাকের চাঁদার একটি বড় অংশ হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশের কাছে চলে যায়। তবে বাসের চাঁদাবাজিতে প্রাধান্য মালিক ও পরিবহন শ্রমিক সমিতির। দূরপাল্লার বাসের চেয়ে পুলিশের লক্ষ্য থাকে স্বল্পপাল্লার যানবাহন।

পরিবহনমালিকেরা বলছেন, বিভিন্ন নামে চাঁদা দিতে গিয়ে তাঁরা সমস্যায় পড়ছেন। বিশেষ করে যাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনেছেন, তাঁরা ব্যাংকের টাকা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেন না।

 এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছেও চাঁদাবাজির অনেক অভিযোগ আসে। এটা বন্ধ করার দায়িত্ব প্রশাসনের। অনেক মালিক শুধু এই ব্যবসার ওপরই নির্ভরশীল। চাঁদাবাজি হবে—সেটা মেনে নিয়েই আমাদের গাড়ি চালাতে হচ্ছে।’

বাসে চাঁদাবাজি

রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার বাস ছেড়ে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে। চাঁদা না দিয়ে কোনো বাস টার্মিনাল থেকে বের হতে পারে না।

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, গাবতলী থেকে প্রতিদিন চার হাজার যাত্রীবাহী বাস দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সেন্ট মার্টিন ট্রাভেলস, সেবা, গ্রিন লাইন, শ্যামলী ও এস আর ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে তাঁরা সরাসরি কিছু বলতে চাননি। তাঁদের কয়েকজন পরামর্শ দেন যাঁরা চঁাদার স্লিপ দেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে। 

গাবতলী টার্মিনাল পুলিশ ফাঁড়ির পাশেই চাঁদা আদায়ের বুথ। গত ৩০ জুলাই দুপুরে সেখানে রসিদ বই হাতে তিন যুবক বসে ছিলেন। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে গেলে তাঁরা বলেন, ‘আমরা কর্মচারী, নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন।’ 

>

হাইওয়ে পুলিশের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে মহাসড়কে চাঁদাবাজির চিত্র
মালিক-শ্রমিকের কল্যাণের নামে ২১৫ সংস্থা-সংগঠন বাস-ট্রাক থেকে চাঁদা তোলে
পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক নেতারা চাঁদার ভাগ পান বলে অভিযোগ

বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, টার্মিনাল ছাড়ার সময় প্রতিটি বাসকে মালিক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন এবং পার্কিং ফি বাবদ ৪০ টাকা করে ১২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া সড়কের বিভিন্ন স্থানে যেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করে, সেখানকার মালিক-শ্রমিক সংগঠনকে চাঁদা দিতে হয় ৫০ টাকা করে। সব মিলিয়ে একটি বাসকে আসা-যাওয়ার জন্য চাঁদা দিতে হয় ২৪০ টাকা।

মহাখালী বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে টার্মিনাল ছেড়ে যায় ৬০০ বাস। টার্মিনাল ছাড়ার সময় বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির নামে প্রতিটি বাসকে পার্কিং ফি ৪০ টাকা, মালিক-শ্রমিক সমিতি পরিচালন ব্যয় ১১০ টাকা ও শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের জন্য ২০ টাকা দিতে হয়।

মহাখালী বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, প্রতিদিন তোলা চাঁদার মধ্যে টার্মিনাল ফি সিটি করপোরেশনকে, মালিক-শ্রমিক সমিতি পরিচালন ব্যয় ও শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড আলাদা করে তহবিলে জমা করা হয়। তিনি বলেন, প্রতিটি রুটে ২০-২৫টি স্থানে চাঁদা দিতে হয় মাস হিসেবে।

 নেত্র পরিবহনের চালক সুজিত চন্দ্র সরকার বলেন, ঢাকা-নেত্রকোনা মহাসড়কে পুলিশকে ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ বাস ছেড়ে যায়। প্রতিটি বাস টার্মিনাল ছাড়ার আগে ৭০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। টার্মিনাল মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ৭০ টাকার মধ্যে ৪০ টাকা পায় মালিক সমিতি, আর শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন পায় ৩০ টাকা।

সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়া খুলনাগামী একটি পরিবহনের ব্যবস্থাপক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, প্রতিটি কাউন্টার থেকে যাত্রাবাড়ী থানাকে মাসে গড়ে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়।

এই অভিযোগের বিষয়ে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলামের বক্তব্য, তিনি থানায় নতুন এসেছেন। চাঁদার বিষয়ে কিছু জানেন না।

ট্রাক টার্মিনাল

বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসা-যাওয়া করে প্রায় ১০ হাজার ট্রাক। কোরবানির ঈদের সময় তা আরও ৫-৭ হাজার বেড়ে যায়। সব ট্রাককে প্রতিটি মহাসড়কের অন্তত ৩০টি স্থানে চাঁদা দিতে হয়। 

এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী খান বলেন, ট্রাক ব্যবসায় খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। একটি ট্রাক মাসে ভাড়া হয় সর্বোচ্চ সাতবার। প্রতি ট্রিপে (আসা–যাওয়া) ১৫ হাজার টাকা ভাড়া হিসাবে মাসে গড়ে আয় ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। চালক, হেলপার, কিপারের (মালামাল ওঠানামায় সহযোগী) বেতন বাবদ চলে যায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। চাঁদার পেছনে যায় প্রায় সমপরিমাণ টাকা। মাস শেষে আর কিছু থাকে না। 

রাস্তায় ট্রাক থেকে চাঁদা তোলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার জয়দেব চৌধুরী বলেন, কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা। 

বাংলাদেশ আন্তজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের শ্যামপুর শাখার এক সদস্য জানান, আইজি গেট, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট, চৌরাস্তা, জুরাইন রেলগেট, দোলাইরপাড়ে ট্রাক থেমে মালামাল ওঠানামা করলেই ট্রাফিক পুলিশকে ২০০ টাকা দিতে হয়।

সার্বিক বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মালিক-শ্রমিক কল্যাণের নামে তোলা চাঁদায় পরিবহন খাতের কয়েকজন নেতা লাভবান হন। আবার মহাসড়কে চাঁদা তুলে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য। অর্থাৎ রক্ষকই নেমে পড়ে ভক্ষকের ভূমিকায়। চাঁদাবাজির কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন প্রকৃত মালিক-শ্রমিকেরা। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তাঁরা পরিবহন ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে পণ্যের ওপর। সব মিলিয়ে জনগণকেই সবকিছুর খেসারত দিতে হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় প্রশাসনের সদিচ্ছা। প্রশাসন চাইলেই এটি বন্ধ করতে পারে।