রোগীর চাপে বেসামাল, পরিবেশও নোংরা

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেলের তিনতলায় জমে থাকা পানিতে রয়েছে মশা জন্মানোর ঝুঁকি।  সাইয়ান
বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেলের তিনতলায় জমে থাকা পানিতে রয়েছে মশা জন্মানোর ঝুঁকি। সাইয়ান

ঢাকার বাইরে তিনটি জেলার সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। নিয়মিত রোগীর পাশাপাশি বাড়তি এই রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। কোনো কোনো হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের নালা, শৌচাগার, ঝোপঝাড়ে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে দেখা গেছে মশাও।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্য সময় এমনিতে শয্যার বিপরীতে প্রায় 

দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকে। তার ওপর এখন ডেঙ্গু রোগীর চাপ। গতকাল দুপুরে হাসপাতালটিতে ২৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। তাদের মধ্যে ১৪৫ জন পুরুষ, ৫২ জন নারী ও ৬১টি শিশু। দুপুর পর্যন্ত বিগত ২৪ ঘণ্টায় এই হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয় ৫০ জন। এ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত চারজন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে। 

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ২৭ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। আর কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল ৫৪ জন। 

কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন রওশন আরা প্রথম আলোকে জানান, জেলায় গতকাল পর্যন্ত ৩৬৮ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩১৪ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। বিগত ২৪ ঘণ্টায় ১৮ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। তবে জেলায় কোনো ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।

পরিচ্ছন্নতা পরিস্থিতি

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, চতুর্থ তলায় নতুন চালু হওয়া স্বতন্ত্র ডেঙ্গু ওয়ার্ডটি মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। তবে বেসিনের আশপাশ খুবই নোংরা। ওয়ার্ডটিতে শুধু নারী রোগীরা আছেন। অনেকেই শয্যার অভাবে মেঝে ও করিডরে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। করিডরে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে চিকিৎসা নেওয়ায় রোগীদের অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। তৃতীয় তলায় মেডিসিন বিভাগের একটি পুরুষ ওয়ার্ডে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারকাজ চলছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এর করিডরে পানি জমে আছে। কিন্তু তা অপসারণের ব্যবস্থা নেই।

মেজবাহ উদ্দীন নামের রোগীর এক স্বজন বলেন, মেঝেতে থাকা রোগীদের ধুলাবালু ও ময়লার মধ্যে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। শৌচাগারগুলোর মেঝেতে পানি থাকে সব সময়। এই পানি পায়ে পায়ে ওয়ার্ড-করিডর হয়ে সব জায়গায় পৌঁছায়। এই পরিবেশে চিকিৎসা করাটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ।

কুষ্টিয়ায় জেনারেল হাসপাতালে সকালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল চত্বরে ও জরুরি বিভাগের সামনে বেশ কিছু জায়গাজুড়ে পানি জমে আছে। এ ছাড়া ভেতরে নালার পানিও জমে আছে। সেখানে পরিষ্কার পানিতে মশাও দেখা গেল। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোসাম্মাৎ নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘হাসপাতাল চত্বরের পানি বের করার জন্য পৌরসভাকে চিঠি দিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি। আর পরিচ্ছন্নতাকর্মী না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও পানি সরাতে পারছে না।’

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। বাইরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নির্মাণসামগ্রী। এ কারণে হাসপাতালের বাইরের অংশে অনেক জায়গায় পানি জমে থাকতে দেখা যায়। ভেতরের নালাগুলোতেও ময়লা পানি জমে থাকতে দেখা যায়। কিছু জায়গায় ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা হয়েছে বলে মনে হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। কয়েকজন বলেন, হাসপাতাল থেকে মশা মারার কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। তবে সিটি করপোরেশন মাঝেমধ্যে এসে ফগারিং করে যায়। এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক এ টি এম মঞ্জুর মোর্শেদের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। 

হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবকাঠামো, চিকিৎসক–নার্স সংকটের মধ্যে ডেঙ্গুসহ অন্য রোগীদের চিকিৎসাসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে গলদঘর্ম চিকিৎসকেরা। কাগজে-কলমে ১ হাজার শয্যার হাসপাতাল হলেও এখানে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার থেকে ১ হাজার ৮০০ রোগী ভর্তি থাকে। গতকালও এই হাসপাতালে দেড় হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। হাসপাতালের পরিচালক মো. বাকির হোসেন বলেন, ‘সীমিত চিকিৎসক ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যেই আমরা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি। আগে যেখানে একজন চিকিৎসককে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো, এখন তাঁকে ২৪ ঘণ্টাই সময় দিতে হচ্ছে।’

কুষ্টিয়ার জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও সব মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক রোগী ভর্তি আছে সেখানে। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক রয়েছেন অর্ধেক। ডেঙ্গু ওয়ার্ড ও সাধারণ ওয়ার্ড হিসেবে দুটি রোস্টারে চিকিৎসকদের তালিকা করা হয়েছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে প্রতিদিন দুজন চিকিৎসক পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিচ্ছেন। এ ছাড়া তিন শিফটে মেডিকেল কলেজের ছয়জন করে ইন্টার্ন চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা জানান, সরকারি ছুটির দিন প্যাথলজি বিভাগ বন্ধ থাকে। এ ছাড়া কর্মদিবসেও বিকেল পাঁচটার পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। 

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সব পরীক্ষা করা হলেও অনেক রোগীর অভিযোগ, চিকিৎসকেরা বেসরকারি ‘সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ থেকে রক্ত পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, এই হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিবেদনে পার্থক্য থাকে। তবে হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে রোগীদের তেমন অভিযোগ না থাকলেও কেউ কেউ এক দিন পরপর চিকিৎসক আসেন বলে অভিযোগ করেন।