কাননবালা খুঁজছিলেন দুল, আর মুরাদ ঢোল

মিরপুরের পোড়া বস্তিতে অনেকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন শেষ সম্বলটুকু। ছবি: হারুন আল রশীদ
মিরপুরের পোড়া বস্তিতে অনেকেই খুঁজে বেড়িয়েছেন শেষ সম্বলটুকু। ছবি: হারুন আল রশীদ

যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সম্পদ মিরপুরের আরামবাগ ঝিলপাড় বস্তিবাসীরও ছিল। সেই সম্পদ হয়তো অনেক বেশি না। কিন্তু বস্তিবাসীর কাছে যে তা অনেক। শুক্রবারের আগুনে সেই ‘অনেক’ই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বেশির ভাগ বাসিন্দাই একমাত্র প্রাণটা হাতে নিয়ে এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। পেছনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে তাঁদের অনেক দিনের জমানো সম্পদ।

আগুনে পুড়ে সবকিছু ছাই হয়। কিন্তু সোনা যে পুড়ে আরও খাঁটি হয়। আজ দুপুর বেলায় গিয়ে দেখা গেছে, অনেকেই ছাই-ভস্মের মাঝে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিছুই তো অবশিষ্ট নেই, কী খুঁজছেন, প্রশ্ন করতেই মোসাম্মত কাননবালা বললেন, তাঁর ঘরে সোনার তৈরি একটি দুল ছিল। নিয়ে বের হতে পারেননি। আগুন নেভার পর আজ সকাল থেকে খুঁজে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনো পাননি। তাঁর মত আরও অনেককেই নিজেদের ঘরের জায়গায় হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন, যদি কিছু পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ কিছু পেয়েছেন বলে জানা যায়নি। কানন হতাশ কণ্ঠে বললেন, ডোবার ওপর বস্তি। পুড়ে সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

মিরপুর-৭ নম্বরের চলন্তিকা মোড়ে আরামবাগ ঝিলপাড় বস্তির অবস্থান। শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে এই বস্তিতে আগুন লাগে। সাড়ে তিন ঘণ্টার আগুনে সবকিছু পুড়ে ডোবা ভরাটের বর্জ্যে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এই বস্তির গোড়াপত্তন হয় ১৯৭৫ সালে। এটি মূলত একটি ডোবা। পানির ওপরে কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল মাচা। সেই মাচার ওপরে কাঠ ও টিনের তৈরি একতলা ও দোতলা মিলিয়ে ছিল দেড় থেকে দুই হাজার ঘর।

বস্তির বাসিন্দাদের বেশির ভাগই গার্মেন্টসকর্মী। বাকিরা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করাসহ অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত। গতকাল পর্যন্ত অর্ধেকের মতো বাসিন্দা ঈদের ছুটিতে দেশে ছিলেন। যে কারণে অনেকেই বলছেন, জান বেচেছে, মালের ওপর দিয়ে গেছে।

মোকসেদ আলী ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেনাটাতে কাজ করেন। তিনি সব হারিয়ে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে স্থানীয় আবাসিক মোড়ের বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার ঘরে মূল্যবান সামগ্রীর মধ্যে একটি ফ্রিজ ও নগদ ৩০ হাজার টাকা ছিল। কিছুই নিতে পারেননি।
হাজেরা বেগম বস্তিতে তিনটি ঘরের মালিক। একটিতে নিজে থাকেন। অন্য দুটির ভাড়া দিতেন। তিনি বলেন, পরনের কাপড় ছাড়া এক টুকরা সুতা নিয়েও বাইর হইতে পারি নাই।
জামাল উদ্দিন স্থানীয় একটি ফার্নিচারের দোকানে কাজ করেন। তাঁর কথায়, স্ত্রী আর তিন সন্তানের জীবন বেচেছে। আল্লায় মালের ওপর দিয়া নিয়া জান বাঁচাইয়া দিছে।
বাসা-বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ জহুরা বেগম। তিনি এক ছেলে, দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে বস্তিতে থাকেন। ঘটনার সময় তিনি বাইরে ছিলেন কাজে। ফিরে দেখেন কিছুই নেই।

ঢোল বাজিয়ে গান-বাদ্য করে সংসার চালাতেন মুরাদ। তাঁর সব সম্পদের সঙ্গে ঢোলও গেছে। মোশারেফা বেগম মিরপুর-৭ নম্বর মোড়ে মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ খবর পান বস্তিতে আগুন লেগেছে। এসে দেখেন সবকিছু পুড়ে ছাই।
বস্তির মুখে ছোট্ট একটি দোকান বসিয়ে সংসার চালাতেন রহিমা বেগম। দোকানে এক লাখ টাকার বেশি মূল্যের মালামাল ছিল। বাসাতেও ছিল অনেক মাল। আগুন লাগার পর দোকান থেকে ফ্রিজসহ কিছু মালামাল সরিয়ে ওপরে থানা রোডে রাখেন। কিছুক্ষণ পর দেখেন, সেখানে ফ্রিজ ছাড়া আর কিছুই নেই, লুট হয়ে গেছে। তাঁর দোকানের নিচে একটি কুকুর ছিল। কুকুরটি ঘুমিয়ে ছিল। আগুন লাগার পর সে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটোছুটি করেছে। কিন্তু বের হতে পারেনি। আগুন তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

কারা চালায় বস্তি:

আগুন কেন লেগেছে, কীভাবে লেগেছে, তা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে চলছে নানা বিতর্ক। পুলিশ প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য হলো তদন্তের আগে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না। রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) গোলাম রাব্বানী জানান, আগুনের উৎস সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আগুনে কেউ নিহত হয়নি। আহতের সংখ্যাও নগণ্য। আগুন লাগার পর এর দাহ্য উপাদান কাঠ, গ্যাস, কেরোসিন—সবই ছিল। যে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

তবে বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। কারও মতে, এই বস্তির দখলদার অনেক। কারও দখলে দশ ঘর, আবার কারও দখলে ৫০ ঘর। তাই অপেক্ষাকৃত শক্তিধর দখলদারেরা নিজেদের দখলি এলাকাকে আরও সম্প্রসারিত করতে বস্তিতে আগুন দিয়েছে।
বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ বাড়ির দখলদার হলেন—ডিশ বাবু, খলিল মিয়া, আল আমিন, শাহ আলম, গালকাটা বাবু, আখতার মিয়াসহ আরও কয়েকজন। তাঁরা লোক পাঠিয়ে নিয়মিত ভাড়া আদায় করেন। তবে ঘটনার পর কেউই এলাকায় আসেননি।

রূপনগর থানা সূত্র জানায়, বস্তির যারা মালিক, তাঁরা এক সময়ে এই বস্তিতেই ছিলেন। শুরুতে তাদের দখলে একাধিক ঘর ছিল। একটিতে নিজেরা থেকে অন্যগুলো ভাড়া দিতেন। এভাবেই কেউ কেউ এখন বহুতল ভবনের মালিক। কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন।
আগুনে পোড়া বস্তির পাশে আরও একটি বস্তি আছে, যেটিতে আগুন লাগেনি। স্থানীয়রা জানান, এই বস্তিরই তিন শতাধিক ঘরের মালিক কবির মিয়া নামের এক ব্যক্তি। বস্তির সঙ্গে লাগোয়া আছে একটি আটতলা ভবন। সেই ভবনটির মালিক এই কবির মিয়া।

ঘটনার বিষয়ে মিরপুর-৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বস্তিতে নিজেদের বিভিন্ন ঘরের মালিক দাবি করে যারা বাসিন্দাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করেন, তাদের আইনি কোনো ভিত্তি নেই। এ জায়গাতে নতুন করে তাদের ঘর তুলতে দেওয়া হবে না। এই সুযোগ দেওয়া হবে শুধুমাত্র বস্তির বাসিন্দাদের।