বাস টার্মিনাল ও ডিপোগুলো মশার আখড়া

ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে। খানিকটা জমে থাকা পানিতে মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। দিনদুপুরে চলে মশার উৎপাত। গতকাল গাবতলী বাস টার্মিনালে।  ছবি: হাসান রাজা
ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে। খানিকটা জমে থাকা পানিতে মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। দিনদুপুরে চলে মশার উৎপাত। গতকাল গাবতলী বাস টার্মিনালে। ছবি: হাসান রাজা

গাবতলী বাস টার্মিনালের প্রথম প্রবেশপথেই বড় দুটি গর্ত। সেই গর্তে জমে আছে পানি। পানির ওপর একঝাঁক মশা। 

টার্মিনালের ভেতরে দিগন্ত পরিবহনের কাউন্টারে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল, কাউন্টার মাস্টার টিকিট বিক্রি করছেন। মেঝেতে জ্বালানো মশার কয়েল থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ঘড়িতে তখন বেলা দুইটা। জানতে চাইলে কাউন্টার মাস্টার মো. লিটন বললেন, ‘মশার যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। সন্ধ্যা হলে মশা আরও বাড়ে। এখানে মশার আখড়া। একটু ঘুরে দেখলেই টের পাবেন।’

লিটনের কথার সূত্র ধরে কিছুদূর এগিয়ে টার্মিনালের পেছনের অংশে দেখা গেল, এক বিশাল ময়লার ভাগাড় ও হাজারো টায়ারের স্তূপ। পুরো টার্মিনালের আবর্জনা এখানেই ফেলা হচ্ছে।

সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা শহরের এডিস মশার লার্ভা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে থাকা ১২টি স্থানের মধ্যে পাঁচটিই বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপো। গতকাল শনিবার গাবতলী বাস টার্মিনালসহ এই পাঁচটি বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপো ঘুরে জানা গেছে, গত দুই সপ্তাহে এসব স্থানে কেবল একবার মশা মারার ওষুধ দেওয়া হয়েছে। সেটা ছিল ঈদের আগের দিন। যাত্রার আগে দূরপাল্লার বাসেও মশার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। টার্মিনাল ও ডিপো এলাকায় যেখানে–সেখানে ফেলে রাখা ময়লা–আবর্জনাও ঠিকমতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। এই তিনটি বাস টার্মিনালে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ২০০টি বাসে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ যাতায়াত করে। 

সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সর্বশেষ মশা জরিপ অনুযায়ী, বাস টার্মিনালগুলোর ভেতরে-বাইরে মশা জন্মানো ও বংশবিস্তারের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো ও মহাখালী বাস টার্মিনালের ৮০ শতাংশের বেশি পাত্রে লার্ভা পাওয়া গেছে। গাবতলী বাস টার্মিনাল ও মিরপুর ১২-এর বিআরটিসি বাস ডিপোতে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ পাত্রে এডিসের লার্ভা এবং সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ পাত্রে লার্ভা পেয়েছেন জরিপকারীরা। গত ৩১ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ঢাকার ১৪টি এলাকায় এই জরিপ করেছিল। রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জরিপের দুই-তিন দিন পরই তাঁরা ফলাফল দুই সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছিলেন।

টার্মিনালগুলো নোংরা
গতকাল সকাল ১০টার দিকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল, টার্মিনালজুড়েই ময়লা। অসংখ্য স্থানে গর্ত হয়ে পানি জমে আছে। টার্মিনালের মাঝখানের ভবনটির চারপাশের নালাগুলোর পানি উপচে সড়কে এসে জমেছে। প্রতিদিন এই টার্মিনালে হাজারখানেক বাস ধোয়ামোছার কাজ করা হয়। সেসব পানিও জমছে। টার্মিনালের পশ্চিম পাশে ও পেছনে বড় বড় গর্তে পানি জমে আছে। আরেকটু এগোতেই চোখে পড়ল নোংরা পানিতে দুটি ডাবের খোসা।

কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর পূর্ব পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে আটটি বাস। এসব বাসের নিচে ও ভেতরে পানি জমে আছে। দিনের আলোতেও একটি বাসের পেছনের জমে থাকা পানির ওপর একঝাঁক মশা উড়ছিল। ডিপোতে দিনের বেলাতেও মশার উৎপাত অনেক বলে জানান ডিপোর উপব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল) মো. জিলানী। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা লোক দিয়ে কোথাও পানি জমে থাকলে তা ঠিক করার চেষ্টা করি। তবে সিটি করপোরেশন এখানে মশার ওষুধ ছিটায় না।’

>ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ১২ স্থানের মধ্যে পাঁচটিই বাস টার্মিনাল ও ডিপো
গত দুই সপ্তাহে এসব স্থানে একবার মশার ওষুধ দেওয়া হয়েছে
যাত্রার আগে দূরপাল্লার বাসে মশার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না


সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও কমলাপুর বাস ডিপো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল-৫–এর অধীনে। ডিএসসিসির অঞ্চল-৫–এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিশাত পারভীনের দাবি, ১৫ আগস্টে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ও কমলাপুর বাস ডিপোতে দুবার লার্ভা ও মশার ওষুধ ছিটানো হয়েছে। নিয়মিতভাবেই ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। অথচ পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা তা বলতে চান না।

যাত্রার আগে স্প্রে করছে না বাসগুলো
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে কথা হয় ঈগল পরিবহনের চালকের সহকারী মো. রাব্বীর সঙ্গে। যাত্রার আগে বাসে মশার অ্যারোসল স্প্রে করা হয় কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘ঈদে বাস ছাড়ার আগে আমরা মশার স্প্রে করি নাই। মালিক স্প্রে কিনে না দিলে আমরা কইত্তে স্প্রে করুম।’

৫ আগস্ট সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এবারের ঈদযাত্রায় প্রতিটি বাস ছাড়ার আগে মশা নিধনে অ্যারোসল স্প্রে করতে বাসমালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে ৪ আগস্ট ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় দূরপাল্লার বাস ছাড়ার আগে অ্যারোসল স্প্রে করার। 

গতকাল সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এই প্রতিবেদক সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে অন্তত ১৪টি বাস দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যেতে দেখেছেন। যাত্রার আগে এসব বাসের কোনোটিতেই মশার ওষুধ স্প্রে করতে দেখা যায়নি। 

পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আনিসুর রহমান। তাঁরা ভোরে রওনা দিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সায়েদাবাদ নামেন। আনিসুর বলেন, চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরুর আগে বাসে কোনো ওষুধ স্প্রে করতে তিনি দেখেননি। 

বেলা একটার দিকে গাবতলী বাস টার্মিনালে কথা হয় রংপুরগামী বাসের যাত্রী মো. আকমলের সঙ্গে। বললেন, ‘আমি দেড় ঘণ্টা ধরে এই টার্মিনালে আছি। এই সময়ে পাঁচটি বাস টার্মিনাল ছেড়ে গেছে। কোনো বাসেই ছাড়ার আগে মশার ওষুধ দেওয়া হয়নি। এত টাকা ভাড়া নেয় বাসগুলো, অথচ ডেঙ্গুর এই সময়ে একটা অ্যারোসল তারা কিনতে পারে না। কেউ সতর্ক না হলে কী আর করার।’

জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালিকেরা তেমনভাবে ওই নির্দেশ মানেনি। তারা না মানলে আর কী করার থাকতে পারে? তবে মাঝেমধ্যে টার্মিনালগুলোতে ওষুধ দিচ্ছি। দুই-একটি বাস কোম্পানি বাসে অ্যারোসল দিচ্ছে। শ্রমিক দিয়ে টার্মিনাল পরিষ্কার করছি। আগে তো কিছুই ছিল না, আমরা এখন যতটুকু পারা যাচ্ছে, করার চেষ্টা করছি।’ 

মহাখালী টার্মিনাল ও মিরপুর বাস ডিপোতে ভিন্ন চিত্র
মহাখালী বাস টার্মিনালে ঢুকতেই দেখা গেল, রাস্তাগুলোতে থাকা অন্তত চারটি ঢাকনাহীন ম্যানহোল। পাঁচটি বাস ধোয়ামোছার কাজ চলছে। কয়েকটি বাসের নিচে স্তূপাকারে আবর্জনা পড়ে আছে। টার্মিনালের পেছনের অংশে বাস মেরামতের দোকানগুলোর সামনে অসংখ্য টায়ার পড়ে আছে। এরই মধ্যে দেখা গেল, ১০–১২ জনকে টার্মিনালের বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা পানি, ময়লা ও নালা পরিষ্কার করতে। এই টার্মিনালে মশার উপদ্রব অনেক বেশি বলে জানান মহাখালী বাস টার্মিনাল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি তারেক মাহমুদ।

বেলা আড়াইটার দিকে মিরপুর-১২–এর বিআরটিসি বাস ডিপোতে দেখা গেল, বড় বড় গর্তগুলো বালু দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ডিপোর বাঁ দিকের নালা থেকে তেল চিটচিটে পুরোনো বর্জ্য ড্রামে করে তুলে বাইরে ফেলছেন। ওই নালার পাশেই বৃষ্টির পরিষ্কার পানি জমে আছে। সে পানি কেউ সরাচ্ছেন না। 

মিরপুর–১২–এর বিআরটিসি বাস ডিপোর প্রধান নিরাপত্তাকর্মী মো. আবুল খায়ের জানান, ১৫ আগস্ট তাঁদের ডিপোতে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা এসেছিলেন। কিন্তু কোনো মশার ওষুধ দেওয়া হয়নি। তাঁদের ডিপোতে অসংখ্য টায়ার পড়ে ছিল। তাঁরা ২০ জন শ্রমিক ভাড়া করে প্রায় ৫৫০টি টায়ার সরিয়েছেন এবং ডিপোর নালায় জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করছেন। তিনি জানান, বাস ডিপোতে অসংখ্য জায়গায় পানি জমে আছে। প্রায় তিন ট্রাক বালু দিয়ে এসব ভরাট করা হচ্ছে।

ঢাকার বাস টার্মিনাল ও বাস ডিপোগুলো এডিস মশা জন্মানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘গাবতলী টার্মিনাল ও কমলাপুর বাস ডিপোতে গেলে অসংখ্য টায়ার পড়ে থাকতে দেখা যায়। এসব টায়ারে এডিস মশা ভালো জন্মায়। প্রতিদিন হাজারো মানুষ টার্মিনালগুলোতে যাতায়াত করে। টার্মিনালগুলোর নোংরা পরিবেশ থাকলে এডিস মশায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।’