বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল ইমরান-সাদিয়ার

সড়ক দুর্ঘটনায় ছেলে হারানোর পর বাক্‌রুদ্ধ মা বিউটি বেগম (মাঝে)। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত ইমরান হোসেনের ছোট বোন তানভীন আক্তার (ডানে) ও মামাতো বোন সুরভি। গতকাল মগবাজারের নয়াটোলায় ইমরানদের বাসভবনে।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
সড়ক দুর্ঘটনায় ছেলে হারানোর পর বাক্‌রুদ্ধ মা বিউটি বেগম (মাঝে)। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত ইমরান হোসেনের ছোট বোন তানভীন আক্তার (ডানে) ও মামাতো বোন সুরভি। গতকাল মগবাজারের নয়াটোলায় ইমরানদের বাসভবনে। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ইমরান-সাদিয়ার সম্পর্কটা বহুদিনের। আর কদিন পরই তাঁদের আকদ হওয়ার কথা ছিল। গাঁটছড়া বাঁধার সেই স্বপ্নে রেখা টেনে দিল মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। অকালেই ঝরে গেল দুটি তরুণ প্রাণ। ইমরান হোসেন (২৮) ছিলেন ব্যবসায়ী। আর সাদিয়া আক্তার (২৪) ছিলেন মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।

শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটায় নরসিংদীর শিবপুরের কারারচর এলাকায় ওই দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়। ইমরানদের বহনকারী প্রাইভেট কারের সঙ্গে সিলেটগামী শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই (ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মদিনা জুট মিলের সামনে) প্রাণ হারান ইমরান। দুর্ঘটনার সময় প্রাইভেট কারে থাকা ঢাকার খিলগাঁওয়ের জান্নাত (২৫) ও উত্তর গোড়ান এলাকার আকিবও (২৭) প্রাণ হারান। গুরুতর আহত সাদিয়াকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রাইভেট কারে থাকা সজল (২৫) নামের আহত আরেক তরুণকে প্রথমে নরসিংদী ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে জান্নাত ও আকিব সাদিয়ার মতোই মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটির এমবিএর শিক্ষার্থী ছিলেন।

পুলিশ, স্থানীয় লোকজন ও ইমরানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে প্রাইভেট কারে চড়ে ইমরান-সাদিয়াসহ মোট পাঁচজন সিলেটে ঘুরতে যান। শুক্রবার রাতে ঢাকায় ফেরার পথে বাসের সঙ্গে প্রাইভেট কারটির সংঘর্ষ হয়। এতে প্রাইভেট কারটি দুমড়েমুচড়ে যায়। বাসটিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খাদে পড়ে যায়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস নরসিংদী ও শিবপুরের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মগবাজারের নয়াটোলা এলাকায় ইমরানদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, ইমরানের লাশ বনানী কবরস্থানে নেওয়ার জন্য ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে। ট্রাকের পেছনে পিকআপ ভ্যানে নির্বাক বসে আছেন ইমরানের বাবা আবুল কালাম আজাদ। কাছে যেতেই পুত্রশোকে কাতর এই বাবা অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ‘আমার সব শেষ। আর কিচ্ছু নাই।’

নয়াটোলার অপ্রশস্ত গলি থেকে ছেলের লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় বাসার চারতলায় বিলাপ করে কাঁদছিলেন ইমরানের মা বিউটি বেগম। বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে তিনি নিচে থাকা ব্যক্তিদের অনুরোধ করছিলেন ইমরানকে না নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাঁর বিশ্বাস, ইমরান মরেননি।

ইমরানের ছোট বোন তানভীন আক্তারের কাছ থেকে জানা গেল, পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ইমরান ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে থেকে নিজেদের ডেকোরেটর ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। সম্প্রতি বাবা আবুল কালাম আজাদ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর হাতেই ছিল সব দায়িত্ব।

ইমরানের মামি তারা বানু বলেন, ‘আইজ (শনিবার) সকাল ১০টার দিকে সাদিয়ার বাড়ি থেইক্যা লোক আইসা কয়, ইমরান নাই। আমরা কিন্তু বিশ্বাস করতে পারি নাই।’

ইমরানের খালু আবদুর রশীদ জানান, ২৪ আগস্ট ইমরান-সাদিয়ার আকদ হওয়ার কথা ছিল। ঈদের আগে দুই পরিবারের সদস্যরা মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

কথা বলার সময় ইমরানের পিঠাপিঠি বোন তানভীন আক্তারের কান্না থামছিল না। তাঁর কান্না ছুঁয়ে যাচ্ছিল আশপাশের সবাইকে। তিনি কাঁদতে কাঁদতেই বলছিলেন, ‘শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ভাইয়া আম্মারে ফোনে বলতেছিল, ভোর চারটার মধ্যে চলে আসবে। ডেকোরেটরের ব্যবসার পাশাপাশি ভাইয়া ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজও করত। গাড়ি নিয়া অনেক রাতে আসত। কিন্তু এইবার যে লাশ আসবে, এইটা তো বুঝি নাই।’

নরসিংদীর ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বেপরোয়া গতিতে পাশ কাটাতে গিয়ে (ওভারটেক) দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।