চীনের মধ্যস্থতায় প্রত্যাবাসন

রোহিঙ্গা । প্রথম আলো ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা । প্রথম আলো ফাইল ছবি

সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার এক বছরের কম সময়ের মধ্যে আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তবে নাগরিকত্বের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। এরপরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের তোড়জোড়ের কারণ চীনের মধ্যস্থতা। কূটনৈতিক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। সব ঠিক থাকলে ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে। 

প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক হলেও শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে রাখাইনে পাঠানো সম্ভব হবে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পররাষ্ট্রসচিব মো.শহীদুল হক।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ঈদের ছুটির আগে (৮ আগস্ট) প্রায় সাড়ে ৩ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের সংস্থাটির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, রাখাইনে স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্ব ইউএনএইচসিআরের। 

এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসনের তারিখ ঘোষণা করেছিল দুই দেশ। ওই বছরের অক্টোবরে ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে তারিখ চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা যেতে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিত প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনের ১৭টি জেলার ১১টিতেই মিয়ানমারের সেনাদের সঙ্গে সংঘাত এখনো চলছে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির। এ ছাড়া উপগ্রহ থেকে ছবি বিশ্লেষণ করে অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, একসময় রোহিঙ্গাদের বসতি ছিল এমন জায়গাগুলোতে পুনর্গঠনের কোনো চিহ্ন নেই। এমন এক প্রেক্ষাপটে ২২ আগস্ট থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে কি না, তা নিয়ে এখনই সংশয় দেখা দিয়েছে। 

গত মাসের শেষ সপ্তাহে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কক্সবাজারের উখিয়ার শিবিরে দুই দফা বৈঠকেও রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়ে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল কক্সবাজার ছেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা–ঢলের দুই বছর পূর্তির আগেই কেন প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত চীনের কারণে প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুই দেশ। কারণ, রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে নিরাপত্তাসহ নানা রকম ঝুঁকির কথা ইদানীং বারবার আলোচনায় আসছে। রাখাইনে নৃশংসতার অভিযোগে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপও বাড়তে শুরু করেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রত্যাবাসন শুরু না হলে রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের দেশগুলো এ অঞ্চলে প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হতে থাকবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য পরামর্শ দিচ্ছে চীন। 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েকটি নিরাপত্তাচৌকিতে হামলার জের ধরে সেখানে অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ দমনপীড়ন শুরু করে। একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পরের কয়েক মাসে রাখাইন ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেয় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকারের মনোভাব বুঝতে গত জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্রের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ওই সূত্র জানায়, ছোট পরিসরে হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হওয়া উচিত। এখনই যদি শুরু না হয়, তা আদৌ করা যাবে কি না, সে প্রশ্নটাই তখন বড় হয়ে উঠবে। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত একাধিক সরকারি কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। রোহিঙ্গাদের জোর করে এবং নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত না করে রাখাইনে ফেরত পাঠাবে না বাংলাদেশ। তবে পরিবেশ অনুকূল হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য সব সময় তৈরি বাংলাদেশ। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রত্যাবাসনের জন্য গত দুই বছরে মিয়ানমারের কাছে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ২০১৮ সালে তালিকা থেকে ৫ হাজার ৩৮৪ জন এবং এ বছরের তালিকা থেকে ৩৪৫০ জনকে রাখাইনের অধিবাসী হিসেবে নিশ্চিত করেছে মিয়ানমার। সবশেষ গত ২৯ জুলাই ঢাকায় দুই দেশের কর্মকর্তাদের বৈঠকে ৬ হাজার পরিবারের ২৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দেওয়া হয়েছে।

এ বছর মিয়ানমার ৩ হাজার ৪৫০ জনকে রাখাইনের অধিবাসী হিসেবে নিশ্চিত করেছে। এদেরই ২২ আগস্টের প্রত্যাবাসনের তালিকায় রাখা হয়েছে কি না জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁরা জানিয়েছেন, রাখাইনে যাওয়ার বিষয়ে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার মতামত জানতে ইউএনএইচসিআরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। 

ঢাকা ও বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, গত জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর থেকেই সরকারের একটি অংশ যেভাবেই হোক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় চীনের কর্মকর্তারা এটাও বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশ কথা তুললে মিয়ানমার তাদের ফেরত নেবে না। আর বিষয়টিকে একান্তই মিয়ানমারের নিজস্ব বিষয় বলেই বিবেচনা করে চীন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ২ হাজার বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে চীনের কর্মকর্তারা প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক উ জিংহাউয়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এক প্রতিনিধিদল ২৪ ও ২৫ জুলাই বাংলাদেশ সফর করে। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে জানান, রাখাইনে প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য মিয়ানমারকে বলেছে চীন। তখন চীনের ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আগস্টের মাঝামাঝি থেকে প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে মত দেন। 

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআআইএসএস) পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মুন্সি ফয়েজ আহমেদ গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের যাওয়াটা শুরু হওয়া উচিত। তারা যেতে শুরু করলে বোঝা যাবে মিয়ানমার আসলে কী করছে। তবে ফিরে গিয়ে রোহিঙ্গারা যদি ভালো না থাকে, অত্যাচারিত হয়, তাহলে প্রত্যাবাসন টেকসই হবে না। তাই পুরো বিষয়টিতে আন্তর্জাতিক নজরদারি থাকতে হবে।