২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি, দ্বিধায় রোহিঙ্গারা

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি

২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন ঠিক রেখে সাড়ে তিন হাজার শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। এ জন্য কাজ করছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ‘ইউএনএইচসিআর’ এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়। শরণার্থীরা ফিরে যেতে রাজি হলে তাঁদের টেকনাফের কেরুনতলী ও নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তের প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে নেওয়া হবে। সেখান থেকেই তাঁদের পাঠানো হবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। তবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার।
আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত টাস্কফোর্সের জরুরি সভায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি নিয়ে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠক শেষে টাস্কফোর্সের প্রধান চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল আলম নেজামী সাংবাদিকদের বলেন, ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে। এখন শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ কার্যক্রম সফল হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক রেখে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়। জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ভন্ডুল এবং প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে কোনো মহলের উসকানি কঠোর হস্তে দমন করা হবে।

তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের বোঝানোর জন্য শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন এবং ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে কাজ করবে। কাল সোমবার থেকে তারা আশ্রয়শিবিরে গিয়ে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের মতামত সংগ্রহ করবে। তবে বৈঠকে কোন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তা ঠিক হয়নি। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত জানাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত বৈঠক হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ওই দিন আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের মুখে প্রত্যাবাসন ভন্ডুল হয়। তখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম মৈত্রী সেতু ও টেকনাফের নাফ নদীর তীরে কেরুনতলী ঘাটে পৃথক দুটি প্রত্যাবাসন কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। আজ কেন্দ্র দুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। টেকনাফের প্রত্যাবাসন কেন্দ্র থেকে প্যারাবনের ভেতর দিয়ে নাফ নদীর মাঝ পর্যন্ত একটি লম্বা কাঠের জেটি তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য কেন্দ্রে তৈরি হয়েছে ৩৩টি আধা-সেমি টিনের ঘর ও চারটি শৌচাগার। কেন্দ্রটি পাহারা দিচ্ছেন ১৬ আনসার ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পের সদস্যরা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২২ আগস্ট দিনক্ষণ ঠিক আছে। আমরা (টাস্কফোর্স) প্রত্যাবাসনের শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করেছি। প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে এখন মোটিভেটেড করা হচ্ছে। তবে টেকনাফের কেরনতলী নাকি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পয়েন্ট থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে, তার সিদ্ধান্ত জানাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ আবুল কালাম, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন, অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসুদ্দৌজা নয়ন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম সরওয়াল কামাল, ইউএনএইচসিআর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।

প্রত্যাবাসন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রোহিঙ্গারা

২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের মুখে মুখে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইসমাইল (৫৫) বলেন, ‘প্রত্যাবাসন শুরু হোক, তা আমরা সবাই চাই। কিন্তু শর্ত আছে। প্রত্যাবাসনের আগে রোহিঙ্গাদের “নাগরিক” হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে মিয়ানমারকে। তারপর রাখাইনে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের নিরাপত্তা দিতে হবে। তবেই রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে সিদ্ধান্ত নেবে।’

বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা সলিমা খাতুন (৩৪) জানান, ২০১৭ সালের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে সেখানকার সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে তাঁর স্বামীকে। ছোট এক বোনকে ধর্ষণ করেছে। আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে বসতি। এখন সেই বসতির কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। তিনি বলেন, ‘আমরা রাখাইনে গিয়ে আরেক শরণার্থী জীবন চাই না। নাগরিক স্বীকৃতি পেলেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেব।’

বালুখালী শিবিরের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি মিয়ানমারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে এসে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করেছে। বৈঠকে আমরা সাফ জানিয়ে দিয়েছি, তিন দফা বাস্তবায়ন না হলে কোনো রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরে যাবে না।’ তাঁদের দাবিগুলো হচ্ছে—রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, রাখাইন রাজ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ ও ফেলে আসা বসতবাড়ি-সম্পদ ফিরিয়ে দিতে হবে এবং কোনো আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে থাকতে রাজি হবে না।

টেকনাফের জাদিমোরা শালবন শিবিরের চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন হচ্ছে বলে শিবিরের ঘরে ঘরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তবে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু তিনিও জানেন না। জোর করে কাউকে ফেরত পাঠানো চেষ্টা করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে বলে তিনি জানান।