কৃত্রিম পায়ে নতুন স্বপ্নের পথে

কৃত্রিম দুই পা দিয়েই পা-চালিত সেলাই মেশিন চালান মাঝবয়সী মো. আলম। ৭ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম কৃত্রিম পা দিয়ে ফুটবলে লাথি দেয়। দেখার জন্য রীতিমতো ভিড় লেগে যায়। মা সাইফুলকে চিকিৎসক বানানোর স্বপ্ন দেখছেন। কৃত্রিম পা নিয়ে ৯ বছরের জান্নাত এখন পাহাড়ি পথে হেঁটে বেড়ায়।

আলম, সাইফুল ও জান্নাতের বাড়ি মিয়ানমারে। দুই বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে এসে বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয় তারা। তবে আলম বাংলাদেশে এসেছেন আরও আগে। তাদের কৃত্রিম পা লাগিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি)।

৭ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম কৃত্রিম পা দিয়ে ফুটবলে লাথি দেয়। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
৭ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম কৃত্রিম পা দিয়ে ফুটবলে লাথি দেয়। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

মিয়ানমারে সাইফুলের পায়ে গুলি লাগে। তার বাবাও মারা গেছেন গুলিতে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার সময় জান্নাত পায়ে আঘাত পেয়েছিল। পরে তার এক পা কেটে ফেলতে হয়। আলম, সাইফুল ও জান্নাত কৃত্রিম পা দিয়ে একেবারে স্বাভাবিক না হলেও দৈনন্দিন কাজ চালাতে পারছেন।

আইসিআরসির যোগাযোগ কর্মকর্তা জামশেদুল করিম জানান, মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প বা শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করছেন তাঁরা। আইসিআরসি গত বছর থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষদের কৃত্রিম অঙ্গ (হাত-পা) সংযোজনের কাজ করছে। আইসিআরসি এ পর্যন্ত ১১৩ জন প্রতিবন্ধীকে কৃত্রিম হাত-পা ও বিভিন্ন ডিভাইস লাগিয়ে সহায়তা দিয়েছে। এ কার্যক্রম চলমান। আইসিআরসির উদ্দেশ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেন কর্মক্ষম বা কিছুটা ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারেন।

গত ৩০ জুলাই কুতুপালং ক্যাম্পে কথা হলো আলম ও অন্যদের সঙ্গে। প্রথমেই দেখা মিলল সাইফুলের। ভিডিও করা বা ছবি তোলার ফুসরত পাওয়াই কঠিন। সাইফুল যে প্রায় দৌড়ায়। তাই একপর্যায়ে একটু ধীরে হাঁটতে বলা হলো তাকে। ছোট সাইফুলের মুখে হাসি লেগেই থাকে। গুলিতে বাবা মারা যাওয়ার ঘটনার আট দিন পরে আহত পা নিয়েই সাইফুল মা ও অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে আসার পর এক বছরের মাথায় আবার সেই পায়েই গুরুতর আঘাত পায়। ফলে হাঁটুর নিচ থেকে পা কেটে ফেলতে হয়।

কৃত্রিম দুই পা দিয়েই  পা-চালিত সেলাই মেশিন চালান মাঝবয়সী মো. আলম। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
কৃত্রিম দুই পা দিয়েই পা-চালিত সেলাই মেশিন চালান মাঝবয়সী মো. আলম। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

দেখেই বোঝা যায়, সাইফুলের মা আয়েশা বেগমের বিয়ে হয়েছিল কম বয়সে। এখনই আয়েশার যা বয়স, তাতে সাইফুল ছাড়াও তাঁর আরও যমজ মেয়ে রয়েছে। বিধবা আয়েশার স্বপ্ন কেবল সাইফুলকে নিয়েই। ছোট্ট সাইফুলকে কোলে বসিয়ে আয়েশা বললেন, আগে সাইফুলকে দেখলে চোখে অন্ধকার নেমে আসত। আর এখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন ছেলেকে চিকিৎসক বানাবেন। ছেলে যখন কৃত্রিম পা দিয়ে দৌড়ে বেড়ায়, ফুটবলে লাথি দেয় তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই। এখন সাইফুল ক্যাম্পের ভেতর স্কুলে যাচ্ছে। মায়ের ভাষায় দুই ক্লাসে (দ্বিতীয় শ্রেণি) পড়ে ছেলে। মিয়ানমারের নাগপুরে ছিল সাইফুলদের বাড়ি। দুই বছর ধরে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ঘরটিই তাদের বাড়ি।

এরপর দেখা হয় জান্নাতের সঙ্গে। তারা ছয় বোন, দুই ভাই। জান্নাতের বাবা নূর আহমদ জানালেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পথে জান্নাত পায়ে আঘাত পেয়েছিল। পরে তার এক পা কেটে ফেলতে হয়। সাত মাস আগে জান্নাতের পা লাগানো হয়েছে। এখনো জান্নাত স্কুলে যায় না। তবে ক্যাম্পের পাহাড়ি পথে একাই হাঁটাচলা করতে পারে।

কৃত্রিম পা নিয়ে ৯ বছরের জান্নাত এখন পাহাড়ি পথে হেঁটে বেড়ায়। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
কৃত্রিম পা নিয়ে ৯ বছরের জান্নাত এখন পাহাড়ি পথে হেঁটে বেড়ায়। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

১৯৯১ সালে মিয়ানমারে মাইনের আঘাতে আহত হন মো. আলম। তারপর বাংলাদেশে আসেন। হামাগুড়ি দিয়ে তিন দিনে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসেন। আলমের এক মেয়ে দুই ছেলে। দুই বছর আগে থেকে পরিবার নিয়ে আলম আছেন কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে। আলম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টেইলারিংয়ের কাজ করেন। তাঁর মালিক স্থানীয় রামুর বাসিন্দা। যতটুকু কাজ করতে পারেন সে অনুযায়ী আলম মজুরি পান। পা–চালিত মেশিনের সঙ্গে আলাদা একটি মোটর লাগিয়ে নিয়েছেন আলম। ইলেকট্রিসিটি দিয়ে চলে মোটর। ফলে পা দিয়ে তেমন জোরে ঠেলা না দিলেও মেশিন ঘুরতে থাকে। ফলে কৃত্রিম দুই পা দিয়েই আলমের সেলাই মেশিনের চাকা ঘুরতে থাকে। আলম জানালেন, মোটর ছাড়াও মেশিন চালাতে পারেন, তবে তাতে পায়ে একটু বেশি চাপ লাগে। প্রতি পিস কাপড় সেলাইয়ে আলম পান ৫০ টাকা। সেই হিসাবে দিনের আয় হয়।

হাঁটুর নিচ থেকে দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে আলমের। কৃত্রিম পা লাগানোর আগে হাঁটু দিয়েই হাঁটার কাজ চালাতেন। তবে এখন কৃত্রিম পায়ে এমনকি মাঝেমধ্যে ক্রাচে ভর না দিয়েই হাঁটতে পারেন। টয়লেটে যাওয়াসহ দৈনন্দিন অনেক কাজই এখন সহজ হয়ে গেছে তাঁর।