এবার বোয়ালখালীর ইউএনওর চরিত্র হননের চেষ্টায় সেই চক্র

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একরামুল ছিদ্দিকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপজেলার একজন নারী কর্মকর্তার পাশে দাঁড়ানোর কারণে পরিকল্পিতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট অনেকের অভিযোগ। এতে উপজেলার আরেক নারী কর্মকর্তাকে ইউএনওর চরিত্র হননের জন্য ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন এ ঘটনায় জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। দু–এক দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। এর পেছনে কারোর ইন্ধন আছে বলে আমরা জেনেছি। ইন্ধনদাতা বা ষড়যন্ত্রকারীকে চিহ্নিত করতে পারলে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেব।’

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বোয়ালখালী উপজেলার এক নারী কর্মকর্তা ৮ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে ইউএনওর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। এতে বলা হয়, ৭ আগস্ট বেলা আড়াইটায় ইউএনও ফোনে নারী কর্মকর্তাকে তাঁর দপ্তরে ডেকে পাঠান। নারী কর্মকর্তা ইউএনও কার্যালয়ে গিয়ে তিন ব্যক্তিকে দেখতে পান। ওই তিন ব্যক্তির সামনে ইউএনও তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। এক ঘণ্টা পর ওই তিন ব্যক্তি চলে গেলে ইউএনও তাঁকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করেন।

মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এই নারী কর্মকর্তা প্রথম আলোর কাছেও ইউএনওর বিরুদ্ধে একই বক্তব্য দেন।

সরেজমিনে গিয়ে উপজেলায় সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোয়ালখালীর প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুপ্তশ্রী সাহাকে সম্প্রতি নাজেহালের ঘটনার সঙ্গে কথিত শ্লীলতাহানির যোগসূত্র রয়েছে। উপজেলার ১২টি সেতু নির্মাণের জন্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার দরপত্রের ফরম উন্মুক্তভাবে বিক্রি না করতে সুপ্তশ্রী সাহাকে অনুরোধ করেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু এই কর্মকর্তা তাঁদের এ আবদার রাখেননি। এরপর ১৯ জুন সুপ্তশ্রী সাহাকে ফোন করে গালমন্দ করেন নেতা–কর্মীরা। তাঁর চরিত্র হনন করে ফেসবুক ও ভুঁইফোড় অনলাইন পোর্টালে খবর প্রকাশ করা হয়।

সুপ্তশ্রী সাহাকে নাজেহাল করা নিয়ে তখন একাধিক প্রতিবেদন প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়। এ ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় দু–একজন নেতা ও দু–একজন সাংবাদিক জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। তখন সুপ্তশ্রীর পাশে দাঁড়ান ইউএনও একরামুল ছিদ্দিক। এ কারণে ওই মহলটি ইউএনওর চরিত্র হননের চেষ্টা করছে অভিযোগ উঠেছে।

কী ঘটেছিল সেদিন

চরিত্র হনন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট ও সংবাদ প্রকাশ করলে স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী মহিউদ্দিন ও স্থানীয় একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন সুপ্তশ্রী সাহা। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার দপ্তরে নিয়মিত আড্ডা ও দাপ্তরিক কাজ করতেন মহিউদ্দিন। তাঁকে উপজেলা ভবন থেকে চলে যেতে বলা হয়। এরপর উপজেলা ভবনের অদূরে তথ্যসেবা দপ্তরে নিয়মিত আড্ডা দেওয়া শুরু করেন মহিউদ্দিন। বিষয়টি ইউএনওর গোচরে আসে।

ইউএনও একরামুল ছিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহিলাবিষয়ক দপ্তর থেকে মহিউদ্দিনকে বের করা দেওয়া হয়। এরপর তথ্যসেবা দপ্তরে তিনি আড্ডা বসান। এ জন্য তথ্যসেবা কর্মকর্তাকে আমার দপ্তরে ডেকে আনি। মহিউদ্দিনকে জায়গা না দিতে কঠোর নির্দেশ দিই।’ 

একরামুল ছিদ্দিক বলেন, ‘আমার দপ্তরে তখন দুজন স্থানীয় সাংবাদিক ও দপ্তরের একজন কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। পরে শুনতে পাই, আমি নাকি তথ্যসেবা কর্মকর্তার শ্লীলতাহানি করেছি। এটা আমার জন্য লজ্জার এবং দুঃখজনক। সুপ্তশ্রীকে যারা নাজেহাল করেছে, তারাই আমার পেছনে লেগেছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় সাংবাদিক হোসেন মাহমুদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহিউদ্দিনকে জায়গা না দিতে তথ্যসেবা কর্মকর্তাকে আমাদের সামনে ইউএনও কঠোর নির্দেশনা দেন। তথ্যসেবা কর্মকর্তা বলেছিলেন, মহিউদ্দিনের চাচাতো বোন তাঁর দপ্তরে চাকরি করেন। এ জন্য মহিউদ্দিন সেখানে যেতেন। আমাদের সামনে ওই নারী কর্মকর্তা ইউএনও দপ্তর থেকে নিজ দপ্তরে ফিরে যান। তাহলে তাঁর শ্লীলতাহানি কীভাবে হলো?’

প্রত্যক্ষদর্শী আরেক সাংবাদিক মো. সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এস এম জিন্নাত সুলতানার প্রশ্রয়ে মহিউদ্দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তথ্যসেবা কর্মকর্তাকে ইউএনওর বিরুদ্ধে উসকে দেন জিন্নাত সুলতানা।’ 

অভিযোগের বিষয়ে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা জিন্নাত সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যসেবা কর্মকর্তা আমাকে ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ফোন করে নিগ্রহের বিষয়টি জানান। সিসিটিভির ফুটেজ দেখলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যেতে পারে।’ কাউকে উসকে দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয় বলে তাঁর দাবি।

এনজিওর সাবেক কর্মী মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যসেবা কর্মকর্তার কাছে বারবার যাওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। আমাকে নিয়ে কেন টানাহেঁচড়া তা বুঝতে পারছি না।’

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, সিসিটিভির ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়েছে। অভিযোগের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। তদন্ত কর্মকর্তা ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে হচ্ছে। তবে প্রতিবেদন দাখিল না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করব না।’