সপ্তাহে দুটি লাইনচ্যুতি, ট্রেনের সূচি বিপর্যয়

ঈদযাত্রায় রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর বিভাগে রেলের সময়সূচি লন্ডভন্ড হওয়ার পর তা আর ঠিক হয়নি। ঈদযাত্রা শুরুর পর থেকে এই তিন বিভাগে চলাচলকারী সব ট্রেন ৩ থেকে ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলছে। সোমবার রংপুর এক্সপ্রেসটি ঢাকা থেকে লালমনিরহাটে পৌঁছে ২২ ঘন্টা ৪০ মিনিট দেরিতে।

রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, ঈদের আগে টাঙ্গাইলে ট্রেনের লাইনচ্যুতির ফলেই এই বিপর্যয়। এর মধ্যে রোববার ঝিনাইদহে কপোতাক্ষ এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

রেলের হিসাবে, চলতি আগস্টের প্রথম ১৯ দিনে পূর্বাঞ্চলে সাতটি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। আর পশ্চিমাঞ্চলে লাইনচ্যুতি হয়েছে আটটি। এর মধ্যে দুটি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান লাইনে। ৯ আগস্ট টাঙ্গাইলে সুন্দরবন ট্রেন লাইনচ্যুত হলে চার ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। টাঙ্গাইল রেলের পূর্বাঞ্চলের অধীন। তবে এই পথ ধরে যেসব ট্রেন চলাচল করে, এর সবগুলোই পশ্চিমাঞ্চলের। পশ্চিমাঞ্চলের অধীনে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর বিভাগ। 

রোববার ঝিনাইদহে ট্রেন লাইনচ্যুতির কারণে সাড়ে আট ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। ঝিনাইদহ পশ্চিমাঞ্চলের অধীন। ঝিনাইদহে লাইনচ্যুতির কারণে রাজশাহী থেকে খুলনা এবং ঢাকা থেকে খুলনার পথে চলাচলকারী সব ট্রেন বিলম্বে চলেছে।

রেলের হিসাবে, ২০১৪ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে ৮৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে ৬৩৯টি, যা মোট দুর্ঘটনার ৭৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে ৩৯৯ বার গুরুত্বপূর্ণ পথে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে গড়ে দুটি করে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে অন্তত একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে গুরুত্বপূর্ণ লাইনে। বাকিগুলো শাখা লাইন ও স্টেশনে ঘটেছে। মূল লাইনে একটি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটলে কয়েক ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এর জের টানতে হয় পুরো সপ্তাহ। 

প্রতিটি আন্তনগর ট্রেন এক সপ্তাহ পর এক দিন বন্ধ থাকে। পুরো সপ্তাহে যেসব ট্রেন বিলম্বে চলাচল করে, বন্ধের পরদিন থেকে সেগুলো স্বাভাবিক করার চেষ্টা হয়। কিন্তু পথে একটি ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা পুরো প্রক্রিয়া ভন্ডুল করে দেয়। এবারের ঈদে কোনো ট্রেনেরই সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল না। এর মধ্যে টাঙ্গাইল ও ঝিনাইদহে দুটি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। এর ফলে সময়সূচি বিপর্যয় অব্যাহত আছে। 

রেলের সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১১ বছরে রেল খাতে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। নতুন লোকবল নিয়োগ হয়েছে ১৩ হাজারের মতো। এরপরও রেলে লাইনচ্যুতির ঘটনা কমেনি।

৩ থেকে ২৩ ঘণ্টা বিলম্ব

ট্রেনের সময়সূচি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে ঢাকার পথে ৩২টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। ঈদে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮টি। গত ১৫ দিনে এই পথে কোনো ট্রেনই সময় মেনে চলতে পারেনি। ৩ থেকে ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিলম্বে চলেছে এসব ট্রেন। গতকালও সব ট্রেন বিলম্বে চলেছে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, সময়সূচি বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও। ঈদে কতগুলো ট্রেন সময় মেনে চলতে পারেনি এবং ট্রেনের সূচি বিপর্যয়ের কারণ জানাতে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা পেয়েই রেল কর্তৃপক্ষ পরিচালন শাখাকে (অপারেশনস) কারণ অনুসন্ধানে প্রতিবেদন তৈরি করার দায়িত্ব দিয়েছে। পাশাপাশি রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে পরিবর্তন এনেছে রেলওয়ে। গতকাল এক আদেশে খোন্দকার শহিদুল ইসলামের স্থলে হারুন অর রশীদকে জিএমের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে সূত্র বলছে, সময়সূচি বিপর্যয়ের কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

তবে রেলওয়ে সূত্র বলছে, ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রীর কারণেই সময়সূচি বিপর্যয় হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে একটি ট্রেনের ২৭ মিনিট লাগে। একটি ট্রেনের সঙ্গে অন্য ট্রেনের চলাচলে তাই প্রায় এক ঘণ্টা ফাঁকা রাখতে হয়। ঈদে যাত্রী বেশি হওয়ার কারণে ওঠানামায় প্রতি স্টেশনে বাড়তি সময় ব্যয় হয়। এ জন্য সেতুর সময়টা মেলানো যায় না। এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানানো হবে। 

জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেনের সময়সূচি বিপর্যয় এবং লাইনচ্যুতির ঘটনার কারণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারণ জেনে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে মানুষের দুর্ভোগ না হয়, সেটি নিশ্চিত করা হবে। 

লাইনে সমস্যা, বগিতে ত্রুটি

রেলের কর্মকর্তারা বলেন, লাইনে সমস্যা হলে কিংবা বগিতে ত্রুটি থাকলে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। রেললাইনে পাথর কম থাকা এবং স্লিপার ও নাটবল্টু আলগা হওয়ায় ট্রেন লাইনচ্যুত হতে পারে। অনেক সময় জরাজীর্ণ লাইনে বেশি গতিতে ট্রেন চললেও লাইনচ্যুত হতে পারে। এ ছাড়া একটি বগির নিচের অংশে বিপুল কলকবজা থাকে। এটাকে ‘আন্ডার গিয়ার’ বলা হয়। কোনো একটা কলকবজায় ত্রুটি হলেই ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। অনেক সময় অতিরিক্ত যাত্রীর চাপেও কলকবজা বিকল হয়ে যেতে পারে। 

রেলের হিসাবে, গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে রেলের পূর্বাঞ্চলে ২৭ বার ইঞ্জিন বিকল হয়েছে। এর ফলে ট্রেন চলাচলে সার্বিক বিলম্ব হয়েছে ৬৪ ঘণ্টা। পূর্বাঞ্চলে মার্চ-এপ্রিলে ইঞ্জিন বিকল হয় নয়বার। তবে এর জন্য ট্রেন বিলম্ব হয়েছে কত ঘণ্টা, তা উল্লেখ করা হয়নি। 

রেলের সময়সূচি বিপর্যয় সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর কৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যে মানুষটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটলেন, তাঁকে আবার ট্রেনে ওঠার জন্য ১০-১৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে রাখা খারাপ দৃষ্টান্ত। রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণেই এমনটি হচ্ছে। 

ট্রেন লাইনচ্যুতির বিষয়ে সামছুল হক বলেন, ট্রেনে কারিগরি ত্রুটি বা সংকেতের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা হয়। কিন্তু লাইনচ্যুতিটা পুরোপুরি অবহেলার ফল। হয় লাইন ও ইঞ্জিন-কোচ রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা হয়নি। আর বিনিয়োগ হয়ে থাকলেও তা অপচয় হয়েছে।