এডিস মশা নির্মূলে ঢাকা উত্তরের চিরুনি অভিযান শুরু

‘এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসকরণ ও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ বা ‘চিরুনি অভিযানের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: সাজিদ হোসেন
‘এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসকরণ ও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ বা ‘চিরুনি অভিযানের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: সাজিদ হোসেন

এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ‘সাব-ব্লক’ ভিত্তিতে অভিযান শুরু করেছে। মশা মারতে চিরুনি অভিযান চালাবে ডিএনসিসি।

‘এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসকরণ ও বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান’ বা ‘চিরুনি অভিযান’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বলেছেন, ‘১৯৯৯-২০০০ সালের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকলে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার আন্দোলন শুরু করছিলাম। তখন অনেকে আমাকে বলেছিল, তুমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে স্লোগান দাও, আলোকিত মানুষ চাই। কিন্তু ময়লা পরিষ্কার কর কেন? তখন আমি তাদের বলেছিলাম, পরিচ্ছন্ন হওয়াই আলোকিত হওয়া। যে মানুষ পরিচ্ছন্ন নয়, তার পক্ষে আলোকিত হওয়া সম্ভব নয়।’

এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ‘সাব-ব্লক’ ভিত্তিতে অভিযান শুরু করেছে। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় গুলশানের ডা. ফজলে রাব্বী পার্কে ডিএনসিসির এই বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান উদ্বোধন করা হয়।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘ডেঙ্গু এবারই প্রথম নয়; ঢাকায় ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগী দেখা গেছে। ডেঙ্গু জ্বরকে তখন ‘ঢাকা ফিভার’ বলা হতো। এরপর ১৯৯৯ সালে থেকে ২০০০ সালে বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রভাব দেখা দিতে লাগল। তখন আমি সংস্কৃতি অঙ্গনের কিছু ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এবং এক হাজার ছাত্র জোগাড় করে যেসব জায়গায় ডেঙ্গু মশা জন্ম নিতে পারে, সেখানে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চালাতাম।’

অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘তখন আমরা ছোট ছোট দলে ভাগ করে কাজগুলো করেছিলাম। সারা বছর ধীরে ধীরে অভিযান চালিয়ে আমরা পুরো ঢাকা শহরকে পরিষ্কার করতে পেরেছি। তখন ঢাকা শহর এখনকার অর্ধেক ছিল। সে জন্য এ কাজ সম্ভব হয়েছে। এখন ঢাকা অনেক বড় শহর। এখন সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পুরোপুরি। তবে তার সঙ্গে আমরাও থাকব। কারণ, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব হলেও বাঁচার দায়িত্ব আমাদের সবার।’

অধ্যাপক সায়ীদ বলেন, আমাদের মধ্যে নোংরামির একটা অভ্যাস আছে। আমাদের খুব অল্প মানুষের বাড়িই পরিপাটি আছে। আমাদের সবকিছু ওলট-পালট, এলোমেলো। আমাদের স্বভাবের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্য আছে। সুতরাং আমাদের এসব দূর করার চেষ্টা করতে হবে।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আরও বলেন, আমরা প্রথমেই দেখেছিলাম ডেঙ্গুর কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে। যেসব জায়গায় এডিস মশার জন্ম হয়, সেগুলো ধ্বংস করে দিতে পারলে, আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলে, নিজ নিজ বাড়ি এবং আশপাশের জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধ সম্ভব।

এডিস মশা নির্মূলের লক্ষ্যে ডিএনসিসি আজ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু করেছে। এই অভিযান পরিচালনার জন্য ডিএনসিসির এই ওয়ার্ডকে ১০টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এগুলোকে আরও ১০টি সাব-ব্লকে ভাগ করে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হবে। এ জন্য প্রতিদিন একটি ব্লকের ১০টি সাব-ব্লকের সব বাড়ি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, খোলা জায়গা পরিষ্কার ও এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করা হবে। এভাবে ১০ দিন কাজ করে এ ওয়ার্ডকে পুরোপুরি পরিষ্কার ও এডিস মশার লার্ভা নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএনসিসি। পর্যায়ক্রমে ডিএনসিসির অন্যান্য ওয়ার্ডে এভাবে অভিযান চালানো হবে বলে জানানো হয়।

উদ্বোধনীতে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এডিস মশা দূর করতে এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ওয়ার্ডভিত্তিক সাব-ব্লক করে কাজ শুরু করেছি। আজ থেকে আমরা বাড়ি বাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাব। বাড়িগুলোয় এডিস মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেলে তাদের সতর্ক করা হবে। জায়গাটি পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। জমা পানি থাকলে ফেলে দেওয়া হবে। তবে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কোনো পাত্রে পানি জমে থাকা দেখলে, এডিস মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেলে তাদের জরিমানা করা হবে। সিটি করপোরেশন প্রথমবার বাসাবাড়িতে গিয়ে সতর্ক করে দিয়ে আসার এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিন পর পুনরায় গিয়ে দেখবে সেটা পরিচ্ছন্ন আছে কি না। দ্বিতীয়বার গিয়ে পরিচ্ছন্ন না পেলে এবং এডিস মশার অস্তিত্ব পেলে সেগুলোকে জরিমানা করা হবে।

মেয়র বলেন, আজ থেকে প্রতিদিন সকালে আড়াই ঘণ্টা এই অভিযান চলবে। ডিএনসিসির ৩৬টি ওয়ার্ডে পর্যায়ক্রমে এই পরিচ্ছন্ন অভিযান চলবে। এরপর নতুন অন্তর্ভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডে এ কাজ করা হবে।

ডিএনসিসি মেয়র বলেন, এ ধরনের অভিযান কেবল ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে সারা দেশে সব ওয়ার্ডে ও পাড়া-মহল্লায় পরিচালনা করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে এডিস মশা ও ডেঙ্গু বাংলাদেশ থেকে দূর হতে পারে।

ডিএনসিসির সচিব রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন। উদ্বোধনীতে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হাই, প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাঈদ আহমেদ, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. মঞ্জুর হোসেন, পরিবেশ জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তারিক বিন ইউসুফ, সিভিল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) খন্দকার মাহাবুব আলমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান, গুলশান সোসাইটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ও ডা. ফজলে রাব্বী পার্কে আসা লোকজন উপস্থিত ছিলেন।

আজ উদ্বোধনের পর গুলশান শুটিং ক্লাব মোড় থেকে গুলশান এক নম্বর গোল চত্বর পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের বিভিন্ন সড়কের বাড়িগুলোয় ডিএনসিসির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ভাগ হয়ে কাজ শুরু করেন।

পরিচ্ছন্নতা অভিযানের শুরুতে গুলশানের ১ নম্বর সড়কের প্রথম বাড়ি জেএল ভবনে যান পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। এটি একটি বাণিজ্যিক ভবন। এখানে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হলে ভবনের ছাদে একটি পাত্রে জমানো পানি দেখতে পান কর্মীরা। সেখানে মশার লার্ভা দেখা যায়। এ সময় মেয়র আতিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী, প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও এ বাড়িতে পরিচ্ছন্নতা পরিস্থিতি দেখতে যান।

মেয়র আতিকুল ইসলাম ডিএনসিসি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বাণিজ্যিক এ ভবনের দায়িত্বরত ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। এরপর মেয়র ও সিটি করপোরেশনের কর্মীদের উপস্থিতিতে এ বাড়ির বাইরে ডিএনসিসির তৈরি করা সতর্কতামূলক স্টিকার ‘এ বাড়ি/স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে’ এবং লাল চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়।