'ব্যথায় মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হয় পা কেটে ফেলি'

‘শরীরজুড়ে হাজারো স্প্লিন্টার। অপসারণ করতে হলে গায়ের সব মাংস কাটা পড়বে—তা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাই অসংখ্য স্প্লিন্টারের অসহ্য ব্যথা নিয়ে প্রতিটি দিন পার করছি।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত রাশিদা আক্তার এভাবেই নিজের শারীরিক কষ্টের বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘ব্যথায় ঠিক হয়ে বসতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। মাঝেমধ্যেই ব্যথায় চিৎকার করি, কান্না করি। ভয়ে নাতিরা কাছে আসতে চায় না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হয় বঁটি দিয়া পা কেটে ফেলি।’

তৎকালীন কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রাশিদা আক্তার ২১ আগস্টের হামলায় গুরুতর আহত হন। শরীরের নিচের অংশে এখনো অসংখ্য স্প্লিন্টার। তবে ডান পা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পায়ের ক্ষত এখনো যায়নি। আঙুলগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে আছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ক্ষত না সারায় ডান পা কেটে ফেলতে হবে।

পুরোনো ঢাকার মাজেদ সরদার রোডের মায়ের ছোট্ট বাড়িতে বসবাস করেন রাশিদা। গত সোমবার সেখানে বসেই রাশিদার সঙ্গে কথা হয়। ২০০২ সালে স্বামী মো. জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুর পরে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন। জাহাঙ্গীর কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

গ্রেনেড হামলা সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এই নারী জানান, সেদিন বেশ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সমাবেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। নারী কর্মীদের ফোন করে জড় করেন। পরে একটার দিকে সবাই মিলে সমাবেশে যান। সমাবেশ চলার সময় তিনি বসেছিলেন আইভি রহমানের কাছাকাছি।

রাশিদা আক্তার । ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন
রাশিদা আক্তার । ছবি : সাবিনা ইয়াসমিন

এটুকু বলে থামেন রাশিদা আক্তার। বাঁ হাতের অনামিকার আংটি ঘুরাতে ঘুরাতে আনমনা হয়ে যান। একপর্যায়ে তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করে। কান্নার ধকল কিছুটা সামলে স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘কান্না-চিৎকারের বীভৎস শব্দ কানে আসে। শব্দের উৎস বুঝতে চোখ মেলার চেষ্টা করি। শরীর সাড়া দেয় না। তবুও উঠে বসি। তাকিয়ে দেখি, আইভি আন্টি বসে আছেন। গ্রেনেড হামলা নিয়ে আর কিছু মনে নেই।’

রাশিদা আক্তার আরও বলেন, হামলার পরে হুঁশ ছিল না। হাসপাতালে নেওয়ার পরে মৃত ভেবে লাশের সঙ্গে রেখে দিয়েছিল। হেঁচকির মতো ওঠায় সে যাত্রায় বেঁচে যাই। টানা দুই বছর দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। এখনো রোজ ২৫টির মতো ওষুধ খেতে হয়।

রাশিদা যখন আহত হন, তখন বড় মেয়ে জাহানারা ফাতেমার বয়স পাঁচ ও ছোট মেয়ে যোবাইদা কুলসুমের বয়স তিন বছর। স্বাভাবিক মায়েদের মতো তিনি মেয়েদের যত্ন করতে পারেননি। রান্না করে খাওয়ানো বা কায়দা করে চুল আঁচড়ানো—কিছুই করা হয়নি বলে মনে আফসোস পুষছেন। বরং তাঁর যেকোনো সময় কিছু (মৃত্যু) হয়ে যেতে পারে ভেবে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিয়ে দেন।

১৯৭৬ সালে জন্ম নেওয়া এই নারী আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। রাশিদা বলেন, ‘নেত্রী আমাকে ফ্ল্যাট, ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, দুই মেয়েকে পাঁচ লাখ করে সঞ্চয়পত্র ও মাসিক পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তা দিয়েই আমার জীবন চলে।’ তবে দলের অন্যরা তেমন খোঁজখবর নেন না বলে বেশ অভিমান জমেছে তাঁর।

রাশিদা বর্তমানে বংশাল থানা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। তিন কামরার বাসার মধ্যেই কেটে যাচ্ছে তাঁর জীবন। কখনো মেয়েদের সঙ্গে গল্প করে, কখনো বই পড়ে সময় কাটে তাঁর। ক্রাচে ভর দিয়ে ঘরের মধ্যে চলাচল করতে পারেন। দলীয় মিছিল–মিটিং হলে সেখানে যান। মৃত্যু পর্যন্ত নেত্রীর (শেখ হাসিনা) পাশে থাকতে চান রাশিদা।