কারামুক্ত হওয়ার পরদিনই প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা

রফিক মিয়া
রফিক মিয়া

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের চিহ্নিত গরুচোর চক্রের প্রধান রফিক মিয়াকে (৩৮) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের টানকৃষ্ণনগর ও জামালপুর গ্রামের মাঝামাঝি স্থানের একটি ডোবা থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রফিক গরু চুরির একটি মামলায় কিশোরগঞ্জ জেলাখানায় ২২ দিন বন্দী থেকে সোমবার জামিনে মুক্ত হন।

রফিক ভৈরবের শিমুলকান্দি ইউনিয়নের মধ্যের চর গ্রামের বাসিন্দা। বাবার নাম কালা গাজী। তিনি বেঁচে নেই। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, এক যুগ আগে রফিক গরু চোর চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কয়েক বছর ধরে নিজেই একটি চক্রের প্রধান হিসেবে দাপটের সঙ্গে সমাজে টিকে ছিলেন। হাওরাঞ্চল বিশেষ করে অষ্টগ্রাম ও নিকলী থেকে নদীপথে প্রায় প্রতি রাতে ট্রলার ভরে গরু চুরি করে আনত রফিক বাহিনী। এই বাহিনীর কবলে পড়ে হাওরের অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অনেকে হয়ে পড়েন ঋণগ্রস্ত। গরুর মালিক যদি রফিকের কাছে এসে নিজের গরু শনাক্তও করতে পারতেন, তবু বিনা খরচে ছাড়িয়ে নিতে পারতেন না। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে গরু ছাড়িয়ে নিতে হতো।

এমন অবস্থায় রফিক বাহিনীকে রুখতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে রীতিমতো ঝড় ওঠে। এক মাস আগে থানা চত্বরে পুলিশ সুপারের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় রফিক বাহিনীর গরু চুরির হাত থেকে রক্ষা পেতে পুলিশের সহযোগিতা চান স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। গণদাবির মুখে পুলিশ ১ আগস্ট রফিককে পাশের জেলা নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। তখন পুলিশ হেফাজতে রফিক গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে গরু চুরি করার কথা অকপটে স্বীকার করেন। এও বলেন, জেল থেকে ফিরে এসে এবার স্বাভাবিক জীবন বেছে নেবেন।

রফিকের পরিবারের সদস্যরা জানান, জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর সোমবার সন্ধ্যায় বাড়িতে আসেন রফিক। এর আগেও তিনি অনেকবার জেলে গেছেন এবং মুক্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছেন। যতবার বাড়ি ফিরে এসেছেন, ততবার তাঁর মেজাজ ফুরফুরে ছিল। কিন্তু এবার ফিরে আসার সময় তাঁর মুখে হাসি ছিল না। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। ঘরেও বেশিক্ষণ বসেননি। শুধু বলেছেন, পরিস্থিতি ভালো না। মনে হয় তাঁকে মেরে ফেলা হবে। জেল থেকেই তিনি এমন আভাস পেয়ে এসেছেন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে রফিকুল রাতে নিজের ঘরে ঘুমাননি।

পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, গতকাল সকাল ৯টার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন রফিক। ১০টার দিকে বাড়িতে আসেন। বাড়িতে বেশি সময় অবস্থান করেননি। ১২টার দিকে একটি মুরগির খামার থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে লাগোয়া গ্রাম একই উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের টানকৃষ্ণ গ্রামের দিকে যান। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে টানকৃষ্ণনগর ও জামালপুর গ্রামের মাঝামাঝি স্থানে একটি ডোবা এলাকা অতিক্রম করার সময় বেশ কয়েকজন মুখোশধারী রফিকের মোটরসাইকেলের গতি রোধ করে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে এবং তাঁর দুই পা বেঁধে ফেলে। কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে ডোবায় ফেলে দিয়ে চলে যায় হামলাকারীরা। এই দৃশ্য অনেকে দেখলেও প্রতিরোধে কেউ এগিয়ে যাননি। বেলা তিনটার দিকে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

রফিকের ভাতিজা অপু মিয়া বলেন, এই খুন পরিকল্পিত ও পূর্বশত্রুতার জের। কয়েকটি চক্র এক হয়ে ঘটনা ঘটিয়েছে। চক্রে গরু চুরির সঙ্গে জড়িত, এমন লোকজনও আছে। রফিকের ভাই ফেরদৌস মিয়ার অভিযোগ, লাগোয়া বাড়ির বাসিন্দা গোলাপ মিয়া। গোলাপের সঙ্গে তাঁদের এখন দা–কুড়াল সম্পর্ক। জমিসংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে বিরোধ। তাঁরা প্রায় নিশ্চিত, গোলাপের নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আর সহযোগিতা করেছেন টানকৃষ্ণনগর গ্রামের লাল মিয়া ও তাঁর ছেলে মো. তানভীর। মধ্যের চর গ্রামের আ. লতিফ ও তাঁর ছেলে আল আমিনেরও হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা রয়েছে।

অভিযোগ বিষয়ে গোলাপের ভাষ্য, ‘ভৈরবের ছোট–বড় সবাই জানে রফিক গরু চোর। তার পেশার মধ্যেই ছোট–বড় অনেক শত্রু রয়েছে। আমার সঙ্গে সামান্য বিরোধ থাকলেও এর জন্য কাউকে খুন করে ফেলতে হবে, এমন নয়।’

ভৈরব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বাহালুল আলম খান বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।