নারায়ণগঞ্জে সাপে কাটার চিকিৎসা নেই

সাপে কাটা রোগীরা মরছে
সাপে কাটা রোগীরা মরছে

সাপে কাটার পর জামাল হোসেনকে নারায়ণগঞ্জের ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে সাপের কামড়ের প্রতিষেধক নেই জানিয়ে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক। যাত্রাপথেই মৃত্যু হয় তাঁর।

প্রতিবেশী ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি এখনো ক্ষুব্ধ জামালের বৃদ্ধ মা সাহারা খাতুন (৮২)। তিনি বলেন, কী লাভ হলো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে? তাঁর ছেলে তো আর ফেরত এলেন না। তার চেয়ে বরং প্রতিবেশী আর পরিবারের লোকজন জামালকে ওঝার কাছে নিয়ে যেত।

নারায়ণগঞ্জে সরকারি হাসপাতালগুলোয় সাপে কাটার চিকিৎসা মিলছে না। চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু হাসপাতাল ও থানায় সাপে কেটে মারা যাওয়ার ঘটনার কোনো রেকর্ড নেই। ফলে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। সিভিল সার্জন বলছেন, নারায়ণগঞ্জের কোনো সরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) না থাকায় তাঁরা ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারছেন না।

গত ২৬ মে সাপের কামড়ে মারা যান নারায়ণগঞ্জের বন্দর ঘাড়মোড়া এলাকার স্যানিটারি মিস্ত্রি জামাল হোসেন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব জামাল হোসেনের পরিবার। তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, সাপে কামড়ানোর আধ ঘণ্টার মধ্যেই জামালকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। হাসপাতালে সাপে কামড়ের কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। বলা হয়, প্রতিষেধক নেই। তখনই তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক। যাত্রাপথেই মৃত্যু হয়।

১৯ আগস্ট সাপের কামড়ে মারা যান রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া মাসুমাবাদ এলাকার বৃদ্ধ বাসেত মিয়া। সম্প্রতি আরও মারা গেছেন রূপগঞ্জের মোস্তফা মিয়া, সোনারগাঁয়ের জাকির হোসেন, খেলাতোন বেগমসহ বেশ কয়েকজন। সাপে কামড়ানোর পর তাঁরা প্রত্যেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। নারায়ণগঞ্জে চিকিৎসা না পেয়ে ঢাকার হাসপাতালে যাওয়ার পথেই তাঁদের মৃত্যু হয়।

গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা হাসপাতালসহ জেলার সব সরকারি হাসপাতালে কথা বলে জানা গেছে, কারও কাছে সাপে কাটা রোগীর প্রতিষেধক (অ্যান্টি ভেনম) নেই।

৩০০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক আবু জাহের বলেন, সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে প্রতিষেধক দেওয়া গেলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। সাপে কাটা রোগীকে বাঁচাতে হলে উপজেলা পর্যায়ে এর সরবরাহ করতে হবে।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষকে বেশি সাপে কাটে। তাদের বাঁচাতে হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। একসময় মানুষের অসচেতনতার কারণে সাপে কাটা রোগী মারা যেত। এখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা না থাকায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে হাসপাতালগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়ে মানুষ আবারও ওঝা–বৈদ্যের দ্বারস্থ হবে।

কেন সেখানে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হচ্ছে না? এ বিষয়ে ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা চিকিৎসক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে সাপের বিষক্রিয়া অনুযায়ী রোগীর শরীরে অ্যান্টি ভেনম প্রয়োগ করা হয়। আমাদের দেশে সব ধরনের সাপের জন্য একই ভ্যাকসিন। ফলে প্রায়ই রোগীর শরীরে অ্যান্টি ভেনম প্রয়োগের পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এতে অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। ভ্যাকসিন প্রয়োগের সময় এবং পরে রোগীকে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য আইসিইউ কিংবা বিশেষ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। আর দরকার এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কিন্তু এই এলাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ সুবিধা নেই। ফলে সাপে কাটা রোগী এলে তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।’

প্রতিবছর কতজন সাপে কাটার কারণে মারা যায় এর কোনো পরিসংখ্যান থানা কিংবা হাসপাতালে নেই। বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, এই ধরনের মৃত্যুতে মামলা না হওয়ায় থানাগুলোতে পরিসংখ্যান থাকে না। রূপগঞ্জ ও আড়াই হাজার থানা-পুলিশের কাছেও এ ধরনের কোনো তথ্য নেই।

সিভিল সার্জন কর্মকর্তা মো. ইমতিয়াজ বলেন, সাপের কামড়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখা হয় না। আরও বলেন, প্রতিষেধকের সরবরাহ কম। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সরকারি হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর ব্যবস্থা না থাকায় চিকিৎসকেরা সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করেন না। কারণ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করতে আইসিইউ থাকা জরুরি। তবে তিনি সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।