ঝিলপাড় বস্তি থেকে আড়াই কোটি টাকা মাসোহারা

পুড়ে যাওয়া মিরপুরের রূপনগর ঝিলপাড় বস্তি। মঙ্গলবার বিকেলে।  ছবি: প্রথম আলো
পুড়ে যাওয়া মিরপুরের রূপনগর ঝিলপাড় বস্তি। মঙ্গলবার বিকেলে। ছবি: প্রথম আলো
>মিরপুরের রূপনগরে পুড়ে যাওয়া ঝিলপাড় বস্তি থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩০ নেতা-কর্মী মাসোহারা তোলেন বলে অভিযোগ।

সরকারি জমিতে কয়েক হাজার ঘর। ঘরগুলো আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। একেকজনের নিয়ন্ত্রণে ২০০ থেকে ৫০০ ঘর। পাঁচ-ছয় হাতের একেকটি ঘর থেকে দুই হাজার টাকা মাসোহারা তোলা হয়। এটি মিরপুরের রূপনগরে পুড়ে যাওয়া ঝিলপাড় বস্তির চিত্র। পুড়ে যাওয়া ৮ হাজার ঘরসহ মোট ১৩ হাজার বস্তিঘর থেকে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা মাসোহারা তোলা হয়। ক্ষমতাসীনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩০ নেতা-কর্মী বস্তিবাসীর কাছ থেকে এই মাসোহারা তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বস্তিবাসী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, স্থানীয় এই নেতারা ঢাকা-১৬ আসনের সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর লোক হিসেবে পরিচিত। তাঁরা রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব হোসেনেরও ঘনিষ্ঠ। আর রজ্জব সাংসদ ইলিয়াসের আশীর্বাদপুষ্ট।

জানতে চাইলে সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা-১৬ আসনের সবাই আমার লোক। যারা অবৈধ সংযোগ দিয়েছে, তারা আর দিতে পারবে না। এটা আমার নজরে এসেছে।’

গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের পাঁচ একর জমিতে গড়ে ওঠা রূপনগরের ঝিলপাড়ের বস্তির একাংশে গত শুক্রবার রাতে আগুন লেগে অন্তত আট হাজার ঘর পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া বস্তির উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের আরও ১৫ একর জমি রয়েছে। সেখানে পাঁচ হাজার অবৈধ বস্তিঘর এখনো অক্ষত আছে।

গত সোমবার রূপনগর ঝিলপাড় নামা বস্তিতে গেলে কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত রহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি পোশাক কারখানার কর্মী। তিনি জানান, পাঁচ-ছয় হাতের একটি ঘর তিনি দুই হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন। দুলালকে প্রতি মাসে ওই টাকা দিতে হতো।

ঝিলপাড় বস্তির একাংশের নিয়ন্ত্রণকারীরা হলেন রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম, আওয়ামী লীগের কর্মী কবির আহমেদ, ৬ নম্বর ওয়ার্ড ইউনিট যুবলীগের নেতা দুলাল হোসেন, যুবলীগের কর্মী ইকবাল হোসেন, জাহাঙ্গীর হোসেন, মোহাম্মদ হানিফ, নুরুল ইসলাম, আনসার মিয়া, মোহাম্মদ দিলু, তুষার ও ছাত্রলীগের কর্মী মিঠু। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হেলাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, মতিউর রহমান ওরফে খোকন, আক্তার হোসেন, খলিলুর রহমান, তৈয়ব আলী ও ডিশ ব্যবসায়ী বাবু বস্তি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত।

বস্তি নিয়ন্ত্রণকারীদের একজন তৈয়ব আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বস্তিতে থাকা আমার ঘরগুলো পোড়েনি। আমি পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংযোগের জন্য নেতাদের টাকা দিই। কিন্তু তাঁদের নাম বলা সম্ভব নয়।’ হেলাল মিয়া দাবি করেন, বস্তিতে ঘরবাড়ি তৈরি বাবদ অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। তিনি গরিব লোককে অল্প টাকায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

এলাকা ঘুরে বস্তি নিয়ন্ত্রণকারী অভিযুক্ত সবার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাঁরা অন্যত্র থাকেন। আগুন লাগার পর তাঁরা এলাকায় আসেন না। 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন বস্তি নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রশ্রয়দাতা। পুড়ে যাওয়া বস্তিতে তাঁর দুই-তিন শ ঘর ছিল। অভিযোগ অস্বীকার করে রজ্জব হোসেন বলেন, বস্তিতে তাঁর কোনো ঘর নেই। এঁদের সঙ্গে তাঁর কোনো ঘনিষ্ঠতাও নেই। এঁরা নব্য আওয়ামী লীগার। 

গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁশের বেড়ার ওপর টিন দিয়ে ছাপরা গড়ে তোলা হয়েছে। ছয় হাতের ছোট্ট একেকটি ঘরে একটি খাটের পাশে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশনসহ আসবাবে ঠাসা। ঘরগুলোতে তিন-চারজন গাদাগাদি করে থাকেন। এখানে বস্তিঘরের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের ১৫ একর জমিতে এই ঘরগুলো গড়ে উঠেছে। এখানেও প্রতিটি ঘর থেকে দুই হাজার টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। সেই হিসাবে পাঁচ হাজার ঘর থেকে মাসে প্রায় এক কোটি টাকা তোলা হয়। 

বস্তিবাসী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অক্ষত বস্তিঘরগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রহিম, ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রাসেল মোড়ল, যুবলীগের কর্মী আলমগীর হোসেন ও ইউসুফ আলী, ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কর্মী মফিজউদ্দিন, আনিসউদ্দিন, যুবলীগের কর্মী কবির হোসেন, মজিবুর রহমান ওরফে ভাঙারি মুজিবর, নাসিরউদ্দিন ওরফে কানা নাসির ও রমজান আলী। 

৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রহমান বলেন, ‘বস্তিতে আমার কোনো ঘর নেই। অবৈধ সংযোগের সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই।’ যুবলীগের নেতা রাসেল বলেন, ‘অবৈধ সংযোগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যারা অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, তারাই আমার নাম বলেছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ অন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি, লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বস্তিবাসীরা অপরাধী নয়, বরং যাঁরা সরকারি জায়গায় ঘর বানিয়ে ভাড়া নেন এবং অবৈধ সংযোগ দিয়ে টাকা নেন, তাঁরাই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তিনি আগুন লাগার পর বস্তি ঘুরে জেনেছেন, এসবের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত।