পার্কে অভিযান চালিয়ে শিক্ষার্থী আটক করে সমালোচনার মুখে পুলিশ

বগুড়া
বগুড়া

বগুড়ায় বিনোদন পার্কে অভিযান চালিয়ে আবারও শিক্ষার্থী হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। গত বুধবার পুলিশ দিনদুপুরে শহরের দুটি বিনোদন পার্কে অভিযান চালিয়ে শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ৩২ শিক্ষার্থীকে আটক করে সদর থানায় নেয়। তাদের দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার পর অভিভাবকদের জিম্মায় দেওয়া হয়।

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এভাবে আটক করে থানায় নেওয়ার ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠলেও বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

পুলিশ সুপার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, অভিভাবকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই এই অভিযান চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু বিনোদন পার্ক নয়; স্কুল-কলেজ ফাঁকি দেওয়া আড্ডাবাজ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আগামী সাত দিন শহরজুড়ে পুলিশের বিশেষ অভিযান চলবে। তিনি বলেন, এটা আইনের বিষয় নয়, নৈতিকতার বিষয়। পুলিশ সেই নৈতিকতার তাগিদেই শিক্ষার্থীদের পার্ক থেকে থানায় নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দিয়েছে।

 তবে বগুড়া সদর থানা-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদিউজ্জামান প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, কারও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নয়; স্কুল ফাঁকি দিয়ে পার্কে আড্ডা দেওয়ায় পুলিশ নিজে থেকেই সেখানে অভিযান চালিয়ে ৩২ জন ছেলেমেয়েকে আটক করে থানায় নেয়। পরে তাদের অভিভাবকদের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।

বগুড়া সদর থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, বুধবার দুপুর ১২টার দিকে বগুড়া সদর থানা–পুলিশ শহরের পৌর পার্ক (এডওয়ার্ড পার্ক) ও ওয়ান্ডারল্যান্ড বিনোদনকেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে ৩২ শিক্ষার্থীকে আটক করে। এরপর গাড়িতে তুলে তাদের সদর থানায় নেওয়া হয়। সেখানে তাদের আটকে রাখার পর অভিভাবকদের ডেকে তাদের জিম্মায় দেওয়া হয়। আটক শিশু-কিশোরদের বেশির ভাগই শহরের বিভিন্ন স্কুল–কলেজের অষ্টম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী। থানায় নেওয়ার পর এসব শিক্ষার্থীকে লজ্জায় মুখ ঢাকতে দেখা গেছে। সামাজিক মান–মর্যাদার ভয়ে তাদের চোখেমুখে ছিল ভীতি–আতঙ্ক।

 অভিযানে অংশ নেওয়া পুলিশের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আটক ছেলেমেয়েরা পার্কে বন্ধুর পাশে বসে ও দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। কারও আচরণই আপত্তিকর ছিল না।

বিনোদন পার্ক থেকে পুলিশ দিয়ে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী এখনো ভীতসন্ত্রস্ত। থানা থেকে ছেড়ে দিলেও লোকলজ্জা ও অভিভাবকদের কাছে ছোট হওয়ায় এখনো তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

 গতকাল বৃহস্পতিবার ভুক্তভোগী পাঁচজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাসায় গিয়ে অভিভাবকের সামনেই কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বুধবারের ঘটনা জানতে চাইতেই শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। দুজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলে, তারা শহরের একটি বিদ্যালয়ে সকালের পালায় ক্লাস শেষে বন্ধুর সঙ্গে পার্কে ঘুরতে যায়। উন্মুক্ত পৌর পার্কের গাছের ছায়ায় একটি বেঞ্চে বসে তারা আইসক্রিম খাচ্ছিল। পার্ক ভর্তি লোকজনের মধ্যে স্কুলের পোশাক দেখেই পুলিশ তাদের আটক করে গাড়িতে তোলে। অনেক অনুরোধ করার পরও কোনো কথা শোনেনি।

আরেকজন শিক্ষার্থী বলে, কোচিং শেষে সহপাঠীর কাছে দরকারি নোট নেওয়ার জন্য পৌর পার্কে যায়। পার্কের একটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। পুলিশ গিয়ে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আটক করে থানায় নেয়। এ সময় একজন পুলিশ সদস্য নানা আপত্তিকর মন্তব্যও করেন।

জানতে চাইলে বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, বিনোদন পার্কে অভিযান চালিয়ে শিক্ষার্থী আটক আইনসিদ্ধ নয়। এই অভিযানের ব্যাপারে তাঁকে কেউ কিছুই জানাননি।

 এদিকে অভিযানের এক দিন পর গতকাল বগুড়ার পুলিশ সুপার তাঁর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। এসপির এই স্ট্যাটাসের পর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে শহরজুড়ে। অনেকেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং সিলেট লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক সামস্-উল আলম বগুড়ার বিনোদন পার্ক থেকে পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থী আটকের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিনোদন পার্ক থেকে আটক করে থানায় নিয়ে আটকে রেখে অভিভাবকদের কাছে সোপর্দ করে নৈতিক শিক্ষার জ্ঞান দেওয়ার অধিকার পুলিশকে কে দিয়েছে? উন্মুক্ত পার্ক থেকে এভাবে শিশু-কিশোরদের আটক করা পুলিশের অতিরঞ্জিত কাজ।

 সমাজবিজ্ঞানের ওই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘পুলিশ দিয়ে শিশু-কিশোরদের আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানার পর নিজেও হতবাক হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। শিশু-কিশোরদের একসঙ্গে বিনোদন পার্কে বসার স্বাধীনতাটুকুও কি এ দেশে নেই? এভাবে শিশু-কিশোরদের পুলিশ দিয়ে হেনস্তা করলে শিশুমনে একধরনের মানসিক ভীতি ও হীনম্মন্যতা তৈরি হবে। মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে কেউ আড্ডা দিলে সেটা দেখার দায়িত্ব শিক্ষক-অভিভাবকের। পুলিশ সুপার বড়জোর কমিউনিটি পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে অভিভাবকদের সচেতন করতে পারতেন। শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে কাউন্সেলিং ও শিক্ষক-অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করতে পারতেন, চিঠি দিয়ে বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের অবগত করতে পারতেন।

এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, বগুড়া শহরে ফুটপাত ভাড়া দিয়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে, পরিবহনে চাঁদাবাজি হচ্ছে, অবৈধ যানবাহন থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে, মাদক বিক্রি হচ্ছে—সেসব অপরাধ দমন বাদ দিয়ে অতি উৎসাহী হয়ে পুলিশ বিনোদন পার্কে অভিযানের নামে শিশু-কিশোরদের মানসিক নির্যাতন করছে। অপরাধ ছাড়া শিশুদের আটক করে থানায় নেওয়া যাবে না। একবার থানা পর্যন্ত নিলে শিশুমনে ভয় ভেঙে যাবে। অপরাধপ্রবণতা বাড়বে।

সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ বজলুল করিম বাহার বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত বিনোদন পার্কে একসঙ্গে বসতে পারবে না, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বসে গল্প করতে পারবে না, এমনটা রাষ্ট্রতন্ত্রের কোথাও লেখা নেই।

 বজলুল করিম বলেন, নির্মল বিনোদনের জায়গা হলো পার্ক। সেখানে বসে ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেবে, গল্প করবে, জীবনকে জানার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস বাড়বে। সামাজিক বন্ধন আরও মজবুত হবে। তাদের পুলিশ দিয়ে আটক করা নিষ্ঠুর আচরণের শামিল।

 প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ বলেন, সিনেমা হলে যাওয়ার পরিবেশ নেই, শহরে নির্মল বিনোদনের কোনো জায়গা নেই, বিনোদন পার্কেও যদি বসা শিক্ষার্থীদের অপরাধ হয়, তবে তারা যাবে কোথায়? তাদের মানসিক বিকাশ হবে কীভাবে? স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিনোদন পার্কে আড্ডা দিলে পুলিশ স্কুল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে পারে, অভিভাবক সমাবেশ করে বিষয়টি নজরে আনতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই পুলিশ দিয়ে আটক করে শিশুদের মানসিক নির্যাতন করার অধিকার তাদের নেই। পুলিশকে জবাবদিহি করতে হবে, শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত বিনোদন পার্কে বসে কী অশ্লীল কাজ করেছে যে তাদের এভাবে পুলিশ দিয়ে হেনস্তা করা হলো? শিক্ষার্থীদের অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো কেন? পুলিশ শিশু অধিকার আইনের ধারা রীতিমতো লঙ্ঘন করেছে। এতে করে ওই কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়েছে। ভুক্তভোগী শিশুরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এর আগে ২০১৩ সালের ১১ জুন বগুড়ার একটি বিনোদন পার্কে একজন নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। ওই অভিযানে আটক করা হয়েছিল ১৪৪ জন তরুণ-তরুণীকে। বিনোদনকেন্দ্রে একসঙ্গে বসে থাকার দায়ে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। অভিযানের ভিডিওচিত্র ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।

২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে শহরের রেস্তোরাঁ ও ফাস্ট ফুডের দোকানে নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে আরেকবার অভিযান চালায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ৪০ শিক্ষার্থীকে আটক করার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় ছাপা হওয়ার পর প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হয়।