চট্টগ্রাম কারাগারে মাদক ব্যবসা, খুন সবই হয়

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকতেই মূল ফটকের ওপর লেখা, ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’। বাস্তবে এখানে টাকায় মিলছে ইয়াবা, গাঁজা। মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন কিছু কারারক্ষী। কারাগারের মতো সুরক্ষিত জায়গা মাদকের আখড়ায় পরিণত হওয়ায় উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় রয়েছে বন্দীদের স্বজন।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ৯০ বন্দীকে কারাবিধি অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ইয়াবা ও গাঁজা উদ্ধারের ঘটনায় বন্দীদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে থানায় মামলা হয়েছে ১৭টি।

কারা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গড়ে ৯ হাজারের বেশি বন্দী থাকে। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মাদক মামলার আসামি। সেবনকারীও আছে এদের মধ্যে। একটি ইয়াবা বড়ি বাইরে বিক্রি হয় ৩০০ টাকায়, আর কারাগারে বিক্রি হয় ১ হাজার ২০০ টাকায়। গাঁজা এক পুরিয়া বাইরে ৩০ টাকা হলেও কারাগারে দাম দেড় শ টাকার ওপরে।

শুধু মাদক নয়, কারাগারের ভেত​র খুনের ঘটনাও ঘটছে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ বন্দীরা। গত ২৯ মে ৩২ নম্বর সেলের ৬ নম্বর কক্ষে আরেক বন্দীর ইটের আঘাতে নিহত হন ১৬ মামলার আসামি অমিত মুহুরী। পরে জানা গেল, অমিত মুহুরী সেলের ভেতর রান্না করে খেতেন। রান্নার চুলার কাজে ব্যবহৃত হতো ইট।

কারাগারে বসে বাইরে খুন করানোর ঘটনাও আছে। এমনই একজন পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ছাগির হোসেন। তাঁকে পুলিশ ২৭ এপ্রিল গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। ছাগিরের ধারণা, সহযোগী মো. মফিজই তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছে। ছাগির এ জন্য শিমুল দাশ, মো. তানভীর ও মো. রাকিব নামের তিন দুর্বৃত্তকে নির্দেশ দেন মফিজকে হত্যা করতে। ওই তিনজন ১৪ মে মফিজকে মারতে গিয়ে মেরে ফেলে রিকশাচালক রাজু আহম্মেদকে, যা পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার আশিকুর রহমান জানান, এই তিনজন কারাগারে গিয়ে ​মফিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ​ করে। তখন ছগির খুনের নির্দেশ দেন।

তবে এসব ঘটনাকে দুর্ঘটনা মনে করেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. কামাল হোসেন। 

কারারক্ষীকে দিয়ে মাদক ব্যবসা

১৫ জুন রাতে নগরের কদমতলী এলাকা থেকে ৫০টি ইয়াবাসহ কারাগারের কারারক্ষী সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই রাতে আজিজুল ইসলাম, দিদারুল আলম ও আলো আক্তার নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই তিনজন পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁরা কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী নুর আলমের লোক। মুঠোফোনে নুর আলমের নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁরা ইয়াবা ও গাঁজা সংগ্রহ করে কারারক্ষী সাইফুলকে দেন। সাইফুল তা নুর আলমের কাছে পৌঁছে দেন।

কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীনও প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ২০ মামলার আসামি নুর আলম কারাগারে বসে কারারক্ষীর মাধ্যমে মাদক ব্যবসা করছেন। তাঁর সঙ্গে জড়িত অন্যদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

নানাভাবে মাদক ঢোকে

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিছু বন্দী আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় সহযোগীদের কাছ থেকে মাদক নিয়ে আসেন। এমনই এক বন্দী নুর মোহাম্মদ হাজিরা দিয়ে ফেরার পর গত ১৭ জুন তাঁর কা​ছ থেকে ৩৫০টি ইয়াবা উদ্ধার করে কারা কর্তৃপক্ষ। এর আগে ১১ জুন কারাগারের যমুনা ১১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বন্দী মনির উদ্দিনের কাছ থেকে ১৪টি এবং সাইফুল করিমের কাছ থেকে ১৬টি ইয়াবা উদ্ধার করে কারা কর্তৃপক্ষ।

কারাগারের ভেতরে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত চলছে বলে জানালেন কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, যাঁরা বন্দীদের মাদক সরবরাহ করছেন, তাঁদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

কেবল বন্দী নয়, চট্টগ্রাম কারাগারের একজন জেলারও মাদকসহ আটক হন। গত বছরের ২৬ অক্টোবর জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে টাকা, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কারাগারে মাদকের রমরমা ব্যবসার কথাও উঠে আসে। কমিটির সুপারিশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনিয়ম–দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে। দুদকের একটি দল ২৩ থেকে ২৫ জুলাই চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দীসহ ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। দলটির নেতৃত্বে থাকা দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, খাবারের সঙ্গেও কারাগারে মাদক ঢোকে।

বিষয়টি স্বীকারও করেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. কামাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারাগারের ভেতর মাদক নেই, তা বলতে পারব না। আদালতে হাজিরা শেষে ফেরার সময় বন্দীরা মাদক নিয়ে আসছেন। তবে পুলিশ বলছে তল্লাশি করা হয়।’

উদ্বেগ

কারাগারের মতো সুরক্ষিত জায়গায় কিছু কারারক্ষীর সহায়তায় মাদক ব্যবসা চলছে। বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে মাদক ব্যবসায় জড়িতদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশ।

এভাবে বন্দীরা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন বন্দীদের স্বজনেরাও। এমনই একজন শুলকবহর এলাকার মো. ফরিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই বেলাল কারাগারে গিয়ে ইয়াবায় আসক্ত হয়েছে। কারাগার থেকে ছাড়া পেলেও এখন ইয়াবা ছাড়া থাকতে পারে না। (শেষ)