'জাহালমের কারাভোগে দায় নেই সোনালী ব্যাংকের'

২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নিরীহ জাহালমকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৬ এ হাজির করা হয়। শুনানি শেষে জাহালমকে সেদিন ঢাকার আদালতের হাজতখানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছবি: আসাদুজ্জামান
২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নিরীহ জাহালমকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত–৬ এ হাজির করা হয়। শুনানি শেষে জাহালমকে সেদিন ঢাকার আদালতের হাজতখানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ছবি: আসাদুজ্জামান

সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত আবু সালেকের পরিবর্তে নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমকে শনাক্তকরণে সোনালী ব্যাংকের কোনো দায় নেই। সোনালী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমকে শনাক্ত করেননি। 

সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদন দিয়ে হাইকোর্টকে এই তথ্য জানিয়েছে। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সোনালী ব্যাংক।

সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী শেখ মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন আবু সালেক। কিন্তু আবু সালেকের পরিবর্তে নিরীহ জাহালমকে শনাক্তকরণে সোনালী ব্যাংকের কোনো দায় ছিল না। এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন না।
সোনালী ব্যাংকের এই আইনজীবী জানান, সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এসব কর্মকর্তার কারও বেতন বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়।

সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনার সব মামলাতেই আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির নাম ছিল। তবে তদন্তে অন্যতম প্রধান আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে টাঙ্গাইলের পাটকলশ্রমিক জাহালামের নামে অভিযোগপত্র দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে জাহালমকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিনা দোষে তিন বছর কারাভোগও করেন তিনি।

গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। এরপর শুনানি নিয়ে জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এরপর হাইকোর্টের আদেশে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পাটকলশ্রমিক জাহালম কারাগার থেকে ছাড়া পান।

প্রধান আসামি আবু সালেক। ছবি: সংগৃহীত
প্রধান আসামি আবু সালেক। ছবি: সংগৃহীত

সোনালী ব্যাংকের ৮ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
আদালতে দেওয়া সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ সালে ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি তদন্ত করে। এরপর সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক এ কে এম সাজেদুর রহমান খান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে মামলার তদন্তভার পায় দুর্নীতি দমন কমিশন।

সোনালী ব্যাংকের টাকা জালিয়াতির ঘটনায় সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা সবিস্তার ৪১৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন হাইকোর্টকে জানিয়েছে। কীভাবে চক্রটি সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, তা–ও জানানো হয়েছে হাইকোর্টকে।

হাইকোর্টে জমা দেওয়া সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখার তৎকালীন সাপোর্টিং সাব স্টাফ মাইনুল হক টাকা আত্মসাৎ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁকে বরখাস্ত করেছে। পাশাপাশি ওই ব্যাংকের আরও সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের দেওয়া হয় বিভিন্ন লঘুদণ্ড।

জালিয়াতির ঘটনার সময় সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা আজিজুল হকের বেতন এক বছর বন্ধ রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়।

এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের আরও ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিভিন্ন লঘুদণ্ড ও তিরস্কার করা হয়। ওই ছয় কর্মকর্তা হলেন ক্যান্টনমেন্ট শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক বেগম আখলাকুন নাহার, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান, নির্বাহী কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন, সাপোর্টিং সাব স্টাফ মিজানুর রহমান ও আজিজুল হকের।

অর্থ আদায়ে সোনালী ব্যাংকের মামলা
সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতে জড়িত আবু সালেকের বদলে জাহালমকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যে জড়িত ছিলেন না, তা প্রতিবেদনে বারবারই উল্লেখ করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সোনালী ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের সময় দায়িত্ব পালনকারী সোনালী ব্যাংকের সাত কর্মকর্তার জবানবন্দি রেকর্ড করে তদন্তকারী দল। তদন্ত দলের কাছে ওই সাত কর্মকর্তা দাবি করেছেন, জাহালমকে আবু সালেক বলে শনাক্ত করে দুদকের কাছে তাঁরা কোনো বক্তব্য দেননি। সোনালী ব্যাংকের ওই সাত কর্মকর্তা হলেন আজিজুল হক, আখলাকুন নাহার, নিজাম উদ্দিন, লুৎফুন্নেছা, নুরুদ্দিন শেখ, ফজলুল হক ও অলকা হালদার।

সোনালী ব্যাংকের আত্মসাৎ করা টাকা আদায় করার জন্য অর্থ আত্মসাতে জড়িত ১৬ জন, একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৭৪ জনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালে ঢাকার আদালতে অর্থ মোকদ্দমা (মানি স্যুট) হয়। এ মামলার বাদী সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই মামলাটি এখন ঢাকার পঞ্চম জেলা জজে বিচারাধীন।
এ ব্যাপারে সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী শেখ মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সোনালী ব্যাংক কিন্তু কোথাও জাহালমকে আসামি করেনি। সোনালী ব্যাংকের আত্মসাৎ করা সাড়ে ১৮ কোটি টাকা উদ্ধারের জন্য প্রধান আসামি আবু সালেকসহ ১৭টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, শাখা ব্যবস্থাপকসহ ৭৬ জনকে বিবাদী করে মামলা করা হয়েছে।

হাইকোর্টে জমা দেওয়া সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, অন্যতম প্রধান আসামি আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। জাহালমের কারাভোগের ঘটনা নিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রথম আলোর প্রতিবেদনের সূত্র ধরে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে।
সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী জাকির হোসেন বলেন, ‘জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের কোনো দায় নেই। কারণ সোনালী ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জাহালমকে শনাক্ত করেননি। প্রতিবেদন দিয়ে হাইকোর্টকে এই তথ্য আমরা দিয়েছি।’

দুদকের ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা
সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনায় নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমকে আসামি করায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। ২১ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন হাইকোর্টকে এক প্রতিবেদন দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে।

তবে প্রতিবেদনে দুদকের ১১ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ না থাকায় ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করেননি হাইকোর্ট। আগামী বুধবার দুদকের ১১ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

ব্র্যাকের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
২১ আগস্ট ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী আসাদুজ্জামান হাইকোর্টকে জানান, আবু সালেকের পরিবর্তে জাহালমের কারাভোগের ঘটনায় ব্র্যাক ব্যাংকের দুজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ব্র্যাকের আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশের পর ব্র্যাকের দুজন কর্মকর্তাকে প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়।