সন্ধ্যা হলে রুমে ঝিম মেরে থাকেন তাঁরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ড্রেনে জমে আছে ময়লা পানি। ছবিটি সাম্প্রতিক। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ড্রেনে জমে আছে ময়লা পানি। ছবিটি সাম্প্রতিক। ছবি: সাইফুল ইসলাম

‘সন্ধ্যা হলেই আমরা রুমে মশারির মধ্যে ঝিম মেরে থাকি’, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের (নতুন ভবন) ২০১২ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা আকাশ পালিত। জগন্নাথ হলের ডেঙ্গু পরিস্থিতি জানতে হলটিতে সরেজমিনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

সারা দেশেই এখন ডেঙ্গু–আতঙ্ক। এ অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি জানতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো দুটি হল জগন্নাথ ও সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলে যাওয়া। দুটি হলের কর্তৃপক্ষই জানাল, তারা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। নিজ উদ্যোগে মশা নির্মূলে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিক্ষার্থী ঠিক কতজন, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত কোনো তথ্য তারা দিতে পারল না। যাও দিল, তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বক্তব্য পুরোপুরি মিলছে না। মশার আবাসস্থল নির্মূলে গৃহীত ব্যবস্থায় বেশ কিছু ঘাটতিও নজরে এল। হল কর্তৃপক্ষের হিসাবে জগন্নাথ হলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত ৪২। আর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সাতজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদে জমে আছে বৃষ্টির পানি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদে জমে আছে বৃষ্টির পানি। ছবি: সাইফুল ইসলাম

জগন্নাথ হলের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই বাঁ পাশে পড়ে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবন, যার ডান পাশে চলছে ‘রবীন্দ্র ভবন’ নির্মাণকাজ। টিন দিয়ে ঘেরা অংশ বাইরে থেকে দেখা যায় না। পার্শ্ববর্তী অক্টোবর স্মৃতি ভবনের ছাদ থেকে নির্মাণাধীন ভবনের অংশটির বেশ কয়েকটি জায়গায় পানি জমে থাকতে দেখা গেল, যা ডেঙ্গু বাহক এডিস মশার আবাসস্থল অনায়াসে হতে পারে। ছাদ থেকে ভবনের নিচে একতলা ক্যানটিনের ছাদেও স্থির জমে থাকা পানি চোখে পড়ল। সবচেয়ে বাজে অবস্থা বলতে হয় হলের ‘মনির ও রফিক ভাইয়ের ক্যানটিন’ নামে পরিচিত দুটি ক্যানটিনের সামনের নালায়। সেখানে জমে থাকা পানিতে মশার লার্ভা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রচুর মশার উপস্থিতি।

জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হল প্রাধ্যক্ষ মিহির লাল সাহা বলেন, ‘বর্তমানে ডেঙ্গু পরিস্থিতিই আমাদের অন্যতম শীর্ষ গুরুত্বের বিষয়। সকাল-বিকেল নিয়মিত মশা মারার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শিক্ষকদের নিয়ে একটি কমিটি করা আছে। সবাই মিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করাই আমাদের লক্ষ্য।’

কিন্তু পরিস্থিতি এবং শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া অন্তত সে কথা বলছে না। সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের ২০১২ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাঞ্জীলাল রায় একধরনের শঙ্কার পরিবেশেরই বর্ণনা দিলেন। হল ছাত্র সংসদের এ সংস্কৃতি সম্পাদক জানান, জুলাইয়ের মাঝামাঝি রুমের একজনের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেই থেকে সবাই মশারি টাঙিয়ে ঘুমান। হল সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক অতনু বর্মণ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কিছুদিন আগে সুস্থ হয়েছেন।

একই রুমের বাসিন্দা ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সদ্য মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়া আকাশ পালিত বলেন, ‘একধরনের শঙ্কা কাজ করছে। মশার উৎপাত রয়েছে। সন্ধ্যা হলেই ছাত্ররা ভয়ে ওয়াশ রুমে পর্যন্ত যায় না। রুমেই ঝিম মেরে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসই নাকি মূলত ডেঙ্গু সিজন। কিন্তু মশা নিধনে কার্যকর কিছু নেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের কার্নিসে জমেছে ময়লা। বৃষ্টি হলেই জমে যায় পানি। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের কার্নিসে জমেছে ময়লা। বৃষ্টি হলেই জমে যায় পানি। ছবি: সাইফুল ইসলাম

হলের নতুন ভবনের ক্যানটিন মালিক শংকর বিশ্বাস জানান, তাঁর ক্যানটিনে ৩৮ জন কর্মী কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে বাবুর্চির সহকারী কবীর হোসেন (৩০) ও বশির হোসেনের (৩৫) ঈদের আগে ডেঙ্গু হয়েছে। হল প্রশাসন থেকে কেউ খোঁজ নেননি।

জগন্নাথ হলে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীর বাস। এর মধ্যে ৪২ জনের ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেল। ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা সম্পর্কে হলের প্রধান স্বাস্থ্যসেবক (ওয়ার্ডবয়) অধর চন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। তিনি জানান, তাঁর অধীনে অক্টোবর ভবনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন সাতজন।

নতুন ভবনের স্বাস্থ্যসেবক সুশীল কুমার দে খাতা দেখে জানান, ২০ জন আক্রান্ত হওয়ার হিসাব রয়েছে তাঁর কাছে। আক্রান্ত অনেকে হলের কাউকে না জানিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। তাঁদের হিসাব নেই এই খাতায়। এ ছাড়া উত্তর বাড়িতে আক্রান্ত হয়েছেন আরও ১১ জন। দক্ষিণ বাড়িতে দুজন আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান স্বাস্থ্যসেবক দীপক দাস। তিনি নিজেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে দিয়ে এসেছেন।

হল প্রশাসনের কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে মেলেনি শিক্ষার্থীদের বক্তব্য। হলের হিসাবে দক্ষিণ বাড়িতে দুজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও সেখানকার গণরুমের শিক্ষার্থীরা বলছেন একটি গণরুমেই সাত থেকে আটজনের আক্রান্তের কথা।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে হলটিতে নিয়মিত ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। হলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী খোকন ঘোষ জানান, দু–তিন দিন পরপর হলের নিজস্ব ফগার মেশিনে ধোঁয়া ছিটানো হচ্ছে। আর সকালে সিটি করপোরেশন এসে ড্রেনে দিয়ে যাচ্ছে লার্ভা মারার ওষুধ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে রুম নম্বর ৮৫–তে এই মাত্র দেওয়া হয়েছে ফগার মেশিনের ধোঁয়া। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে রুম নম্বর ৮৫–তে এই মাত্র দেওয়া হয়েছে ফগার মেশিনের ধোঁয়া। ছবি: প্রথম আলো


তুলনামূলক ভালো অবস্থা এস এম হলের
তুলনামূলক ভালো অবস্থা বলতে হবে এস এম হলের। চারপাশ ঝকঝকে-তকতকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দুদিন আগেই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হয়েছে হলে। হলের পূর্ব দিকে নালা চোখে পড়লেও সেখানকার পরিস্থিতি জগন্নাথ হলের নালাগুলোর মতো নয়।

হলের প্রশাসনিক অফিসের তথ্যমতে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের ভোটার তালিকা অনুসারে এস এম হলে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৮২৪ জন। তবে হলে আবাসিক-দ্বৈতাবাসিক মিলে থাকেন ৭৪৪ জন।

এস এম হলের সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তা নুরুজ্জামান জানান, ‘প্রতি সকালে ড্রেনের পানিতে লার্ভা মারার ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। বিকেলে ধোঁয়া ছিটানো হচ্ছে ফগার মেশিন দিয়ে। হল কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে গত ডিসেম্বরে দুটি মেশিন কিনেছে। একটি লিকুইড ওষুধ ছিটানোর, আরেকটি ফগার মেশিন।’

হলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে নুরুজ্জামান বলেন, তাঁদের হিসাবে আক্রান্ত পাঁচজন। ডেঙ্গু আক্রান্তের কোনো আলাদা তালিকা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি করা হয়নি। তবে বর্তমানে কোনো রোগী নেই হলফ করে বলতে পারি।’

তবে এই তথ্যের সঙ্গে মিলছে না সদ্যই ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠা শিক্ষার্থী এজাজুল ইসলাম। বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এ ছাত্র হলটির ৩৬ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা। হলের পূর্ব ব্লকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত চার থেকে পাঁচজন শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করে তিনি জানান, ঈদের আগে আরও চার থেকে পাঁচজন আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনেছিলেন।

এ বিষয়ে এস এম হলের প্রাধ্যক্ষ মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার বলেন, ‘অনেকের জ্বর ছিল। কিন্তু ডেঙ্গু শনাক্ত হয়নি। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় অনেক তথ্য অনুমানে বলেন। আবার হলের কর্মকর্তারাও অনেক সময় ডেঙ্গু আক্রান্তের কথা জানতে পারেন না। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলা আমার–আপনার সকলের কাজ, তাই সবাই তৎপর রয়েছে।’

দুটি হলেই প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের বক্তব্যের ফারাক রয়েছে। তবে দুটি হলের প্রশাসনই মশা নিধনে তৎপর রয়েছে। জগন্নাথ হলে ডেঙ্গু রোগীর হিসাব রাখতে আলাদা খাতা খোলা হলেও এস এম হলে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই।