প্রহরী-কেরানি থেকে বড় পদে

কেউ পিয়ন, কেউ প্রহরীর মতো চতুর্থ শ্রেণির পদে (২০তম গ্রেড) রেলওয়েতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তাঁরা। পরে তাঁরা ষষ্ঠ গ্রেড বা প্রথম শ্রেণির পদে চলতি দায়িত্ব পান। এরপর রেলওয়েরই বিভিন্ন নিয়োগ কমিটিতে থেকেছেন তাঁরা। গত তিন বছরে এমন পদোন্নতি পেয়েছেন ১১ জন। যদিও ২০তম গ্রেডের কর্মীরা যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে ধাপে ধাপে দশম গ্রেড (দ্বিতীয় শ্রেণি) পর্যন্ত যেতে পারেন; যাদের নিয়োগ কমিটিতে থাকার সুযোগ নেই।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এই ১১ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে পদোন্নতির শর্ত মানা হয়নি। ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত চার ধাপে সৈয়দ আবদুল খলিল, মো. আমজাদ হোসেন, মো. সিরাজ উল্যাহ, মোহাম্মদ আলী, জয়নাল আবেদীন, মোহাম্মদ উল্লাহ, মো. আব্দুর রহমান মিয়া ও আবু খালেদ চৌধুরী ষষ্ঠ গ্রেডে (প্রথম শ্রেণির পদ) চলতি দায়িত্বে পদোন্নতি পান। এই আটজনের মধ্যে মো. সিরাজ উল্যাহ, মোহাম্মদ উল্লাহ ও আবু খালেদ চৌধুরী এখনো কর্মরত, বাকিরা অবসরে​ গেছেন সম্প্রতি। চলতি বছরের ২ এপ্রিল পদোন্নতি পান এস এম আকতার হোসেন, মো. নজরুল আজাদ ও মো. সৈয়দ হোসেন।

এ ধরনের পদোন্নতিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেরানি-প্রহরী থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পাওয়া কীভাবে সম্ভব? এ বিষয়ে আমি অবগত নই। সংক্ষুব্ধ কেউ আমার কাছে এলে কার্যকর ব্যবস্থা নেব।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁদের মধ্যে মো. সিরাজ উল্যাহ কেরানি (ক্লার্ক) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৭ সালে ষষ্ঠ গ্রেডে দায়িত্ব পান। এরপর তাঁকে পাঁচটি নিয়োগ কমিটির সদস্য করা হয়। আবু খালেদ চৌধুরী টাইপিস্ট হিসেবে রেলওয়েতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁকে দুটি নিয়োগ কমিটির সদস্য করা হয়। দুজনই এখনো চাকরিতে আছেন।

একইভাবে ১৯৭৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রহরী হিসেবে যোগ দেন সৈয়দ আবদুল খলিল। ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর তিনি বিভাগীয় সংস্থাপন কর্মকর্তা হন। সম্প্রতি অবসরে যান তিনি। তার আগে তিনি রেলের সিগন্যাল শাখার কর্মী নিয়োগ কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৫ সালের ১৩ নভেম্বর পিয়ন হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করা আমজাদ হোসেনও ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) হন। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি সাতটি নিয়োগ কমিটির সদস্য ছিলেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এসব পদোন্নতির নেপথ্যে রয়েছে ‘নিয়োগ–বাণিজ্যে’ জড়িত এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারসাজি।

জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত ২০টি গ্রেডের (পদমর্যাদা ও বেতন স্কেলের ভিত্তিতে করা) মধ্যে প্রথম থেকে নবম পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত। শুধু দশম গ্রেড দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য। একাদশ থেকে ষোড়শ পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণি এবং সপ্তদশ থেকে বিংশতম পর্যন্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত। কিন্তু রেলওয়েতে নিয়ম ভেঙে তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে ষষ্ঠ গ্রেডে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা সিনিয়র সহকারী সচিব বা ইউএনও পদমর্যাদার।

>

রেলে পদোন্নতিতে অনিয়ম
তিন বছরে এমন পদোন্নতি ১১ জনের
নেপথ্যে নিয়োগ-বাণিজ্য
সচিব নিজেই বিস্মিত

রেলওয়ে সূত্র জানায়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে রেলে বিভাগীয় কোটার ব্যবস্থা রয়েছে। যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২০তম গ্রেডের রেলওয়ের কর্মীরা ধাপে ধাপে দশম গ্রেড (দ্বিতীয় শ্রেণি) পর্যন্ত যেতে পারেন। পদোন্নতি পেয়ে চতুর্থ শ্রেণির কোনো কর্মীর প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদার কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করার নজির এর আগে ছিল না।

 ‘সহকারী কর্মকর্তা’ হিসেবে পদোন্নতি পেতে সাত বছরের অভিজ্ঞতা অথবা পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু সোয়া তিন বছরে যে ১১ জনকে ষষ্ঠ গ্রেডের (প্রথম শ্রেণির) কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়, তাঁরা এই দুটির কোনো শর্ত পূরণ করেননি। তাঁদের একজন মো. নজরুল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালাসি ও প্রহরী থেকে রেলে বিভাগীয় পদমর্যাদার কর্মকর্তা হয়েছেন। তখন প্রশ্ন ওঠেনি। এখন কেন উঠবে?’ তাঁর দাবি, যোগ্যতার কারণে পদোন্নতি পেয়েছেন।

রেলের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রথম শ্রেণির পদে দায়িত্ব পালন করলেও এসব ব্যক্তি পদ অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না। তবে প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য সুবিধা প্রথম শ্রেণিরই ভোগ করছেন।

গত ২ এপ্রিল এস এম আকতার হোসেন, মো. নজরুল আজাদ ও মো. সৈয়দ হোসেনকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তাঁরা নিম্নমান সহকারী (করণিক) হিসেবে রেলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও শর্ত মানা হয়নি। ফলে বঞ্চিত হন বিসিএস ক্যাডারের দুই কর্মকর্তা ও পিএসসির অনুমোদন পাওয়া তিন কর্মকর্তা। সমালোচনার পর এঁদের তিনজনকে পরে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হলেও বাকি দুজন এখনো পিছিয়ে আছেন।

কেন এই পদোন্নতি

২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেলওয়েতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে নিয়োগ পান প্রায় ৯ হাজার জন। এসব নিয়োগের অনেক ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছিল। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন রেলের চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তারা। তাঁদের মধ্যে পিয়ন বা কেরানি থেকে পদোন্নতিপ্রাপ্তরাও রয়েছেন।

রেলের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মাত্র দায়িত্ব নিয়েছি। পদোন্নতি নিয়ে কী ঘটেছে, তা জানা নেই। তবে নিয়মের বাইরে কোনো কিছু করতে দেওয়া হবে না।’

২০১২ সালের এপ্রিলে তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় যাওয়ার পথে বস্তাভর্তি ৭০ লাখ টাকাসহ আটক হন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধা। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে দুদক ১৪টি মামলা করে। প্রতিটি মামলা হয় কর্মী নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মসংক্রান্ত। এরপরও নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি, বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ‘নিয়োগ–বাণিজ্য’ নির্বিঘ্ন করতে চতুর্থ শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে নিয়মবহির্ভূত পদোন্নতি দিয়ে কিছু কর্মচারীকে নিয়োগ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর পেছনে রেলের পঞ্চম গ্রেডের (উপসচিব পদমর্যাদার) কর্মকর্তার ভূমিকা রয়েছে।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এখানে কয়েকটি ঘটনা ঘটছে। প্রথমত, নিয়মের লংঘন হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যোগ্য–দক্ষ লোক সঠিক স্থানে দায়িত্ব পাচ্ছেন কি না? তৃতীয়ত, কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে যোগসাজস। চতুর্থ বিষয় হচ্ছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ কয়েক ধাপ ডিঙিয়ে যে ব্যক্তিটাকে নিয়োগ কমিটিতে রাখা হচ্ছে, এর পেছনে নিশ্চয়ই স্বার্থ রয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা একটা দুর্নীতি। দীর্ঘদিন ধরে এমনটা চলে আসার পেছনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুবিধা পাওয়ার বিষয় থাকতে পারে। তাই তদন্ত করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করতে হবে। নতুবা রেল যে একটা সেবাদাতা সংস্থা, এর চরিত্র হারাবে।