প্রস্তাবে আটকে আছে কেন্দ্রীয় শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় শতাধিক ডাইং ও ওয়াশিংশিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন ৫০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য নির্গত হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০টি প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই।

দূষণের সেই হিসাবে প্রতিষ্ঠানগুলো মাসে ১৫ লাখ ঘনমিটার তরল বর্জ্য নির্গমন করছে। এভাবে বছরে তরল বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটার, যা বিভিন্ন খাল হয়ে সরাসরি শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে পড়ছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ অফিসের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দূষণের বিষয়টি উঠে আসে। তখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য নির্গমনে প্রধান তিনটি খাল চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ইটিপি বা সিইটিপি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু প্রস্তাব দেওয়ার চার বছরেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

ওই সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মঈনুল হক সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বর্জ্য নির্গমন করে পরিবেশ দূষণ করছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের আবার ইটিপি করার পর্যাপ্ত জায়গা ও সামর্থ্য নেই। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ইটিপি করা হলে দূষণ ও পরিচালন ব্যয়—দুটোই কমে আসবে। নদী, খাল, বিল দূষণ থেকে বাঁচবে। নজরদারি করাও সহজ হবে।

প্রাথমিক সমীক্ষা ও অনুসন্ধানে প্রধান খাল তিনটি হলো হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খাল, স্টেডিয়াম-পিঠালিপুল খাল ও সস্তাপুর খাল।

সস্তাপুর খাল: সদর উপজেলার সস্তাপুর খাল ফকির রোড ও হাজীগঞ্জ-শিবু মার্কেট রোডের সংযোগস্থল পর্যন্ত বিস্তৃত। ওই খালে তরল বর্জ্য নির্গমন করছে ১৯টি ডাইং ও ওয়াশিংশিল্প প্রতিষ্ঠান। ১৯টির মধ্যে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের ইটিপি রয়েছে।

হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খাল: হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খালের দুই পাশে ছোট–বড় মিলিয়ে ৬৭টি ডাইং ও ওয়াশিংশিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৬৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০টির নিজস্ব ইটিপি রয়েছে। সস্তাপুর খালের প্রবাহ ফকির রোড ও হাজীগঞ্জÑশিবু মার্কেট রোডের সংযোগস্থলে (রহমান হোসিয়ারি ও সানলাইট ডাইং মোড়) হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। ওই প্রবাহ পিঠালিপুল খাল হয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের জলাশয়ে মিলিত হয়েছে। ওই তরল বর্জ্য জালকুড়ি খাল হয়ে কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন খাল দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে নির্গত হচ্ছে।

ফতুল্লা স্টেডিয়াম-পিঠালিপুল খাল: স্টেডিয়াম-পিঠালিপুল খাল দিয়ে তরল বর্জ্য নির্গমন করছে ১০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৬টির ইটিপি নেই। এসব প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য জালকুড়ি খাল হয়ে কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন খাল দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে পড়ছে।

কেন্দ্রীয় ইটিপি নির্মাণ বিষয়ে প্রস্তাব

প্রস্তাব-১: সস্তাপুর খালের ১৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য, স্টেডিয়াম–পিঠালিপুল খালের ১০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য, হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খালের ৬৭টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য মিলে আনুমানিক ৫০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য নির্গত হচ্ছে। এসব বর্জ্য শোধনের জন্য প্রয়োজনীয় সেফটি মার্জিন রেখে হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খাল ও শীতলক্ষ্যা নদীর সংযোগস্থলে একটি কেন্দ্রীয় ইটিপি নির্মাণ করা হলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ নদীদূষণ কমে আসবে। সে ক্ষেত্রে তিনটি খাল পুনঃখনন, পুনঃসংযোগ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।

প্রস্তাব-২: সস্তাপুর খালটি ফকির রোড ও হাজীগঞ্জ-শিবু মার্কেট রোডের সংযোগস্থলে হাজীগঞ্জ-দাপা ইদ্রাকপুর খালের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। ওই মিলিত প্রবাহ পিঠালিপুল খাল হয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের জলাশয়ে মিলিত হয়েছে। অপরদিকে স্টেডিয়াম-পিঠালিপুল খালের ১০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্যও স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে লিংক রোডের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে স্টেডিয়ামের বিপরীত দিকের জলাশয়ে নদীতে মিলিত হয়েছে। উভয় প্রবাহ জালকুড়ি খাল হয়ে কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন খাল দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে নির্গত হচ্ছে। যেহেতু ৯০ শতাংশ তরল বর্জ্য কাঁচপুর সেতুসংলগ্ন খাল দিয়ে বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীতে নির্গত হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে কাঁচপুর সেতু–সংলগ্ন সরকারি জায়গায় একটি কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণ করা যেতে পারে।

প্রস্তাব-৩: অন্যান্য অপ্রধান খাল বা ড্রেন দিয়ে অল্প পরিমাণে নির্গত তরল বর্জ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ড্রেন বা খাল দিয়ে তরল বর্জ্য নির্গমন বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে এবং সৃষ্ট তরল বর্জ্য পরিবহন বা পৃথক ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ইটিপিতে নেওয়া যেতে পারে।

এ বিষয়ে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেন্ট্রাল বা এলাকাভিত্তিক ইটিপি না করলে পরিবেশদূষণ থেকে আমাদের নদী, খাল, বিল রক্ষা করা সম্ভব হবে না। বড় ডাইং বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইটিপি ব্যবহার করছে। কিন্তু স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলছে। এতে কিন্তু পরিবেশ দূষণমুক্ত হচ্ছে না। তাই সেন্ট্রাল বা এলাকাভিত্তিক ইটিপির আওতায় ডাইং ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আনতে হবে। তাদের কাছ থেকে মাসিক হারে বিল নিতে হবে। সরকার বা পরিবেশ অধিদপ্তরকে এই উদ্যোগ নিতে হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপপরিচালক সাঈদ আনোয়ার বলেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে সেন্ট্রাল ইটিপি স্থাপনের প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এ বিষয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর সমীক্ষা করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। সেন্ট্রাল ইটিপির জন্য জমি অধিগ্রহণ ও বিশেষজ্ঞ মতামতসহ আরও যাচাই-বাছাই প্রয়োজন ছিল। তাই সে সময় বিষয়টি চূড়ান্ত করা যায়নি।

তবে বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ইটিপি স্থাপনের প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে দেখা হবে। তারা যদি এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয় তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।