আরও সুযোগ চান বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা

>
  • দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র ১৩৪ টি
  • ৮০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক বেসরকারি উদ্যোক্তারা
  • জমি কেনার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতিসহ ১০ সুবিধা দাবি

বিদ্যুৎকেন্দ্রের খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি ও জমি কেনার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি দেওয়াসহ নতুন করে সরকারের কাছে ১০টি সুবিধা চেয়েছেন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা। গত জুলাই মাসে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে দেখা করে এসব সুবিধা দিতে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) নেতারা।

তবে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিযোগিতাবিহীন বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পাওয়া ব্যবসায়ীরা এমনিতেই বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদনের সময় পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) সঙ্গে তাঁদের যে চুক্তি হয়েছিল, এর বাইরে গিয়ে হঠাৎ তাঁদের নতুন সুবিধা দেওয়ার সুযোগ নেই।

দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ১৩৪টি। এর মধ্যে ৮০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রর মালিক বেসরকারি উদ্যোক্তারা। তাঁদের প্রায় সবাই বিআইপিপিএর সদস্য। আর দেশে এখন বিদ্যুতের স্থাপিত উৎপাদনক্ষমতা ১৮ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট। এই ক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশ বেসরকারি খাতের।

পিডিবি জানায়, বেসরকারি উদ্যোক্তারা যেসব সুবিধা চেয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের আমদানির অনুমতি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের (রেন্টাল বা ভাড়াভিক্তিক কেন্দ্রগুলো ছাড়া) মেয়াদ বাড়িয়ে ৩০ বছর করা (বর্তমানে সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এসব কেন্দ্রের মেয়াদ ১৫ থেকে ২০ বছর), বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য গঠিত শ্রমিক কল্যাণ তহবিল বিলুপ্ত করা।

এ বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দাবিগুলো নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছে। কিছু দাবির যৌক্তিকতা রয়েছে। এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা যন্ত্রপাতি প্রায়ই আটকে দেয় রাজস্ব বিভাগ, পরে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে চিঠি লিখে তা ছাড়াতে হয়। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা এসব বিষয়ও সরকারের নজরে এনেছেন।

পিডিবি সূত্র জানায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা বহুদিন ধরে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর কর্তৃত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ জন্য তাঁরা প্রথমে দাবি তোলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আমদানি করা জ্বালানি তেলের মান খারাপ। বিপিসির আনা ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের দাহ্যক্ষমতা কম হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে তেল বেশি লাগে। সে জন্য চুক্তির সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ তেল বরাদ্দ করা হয়েছিল, তার পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।

দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করে বিপিসি। তবে সরকার কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে তেল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এসব কোম্পানি তেল আমদানি করতে বিপিসির অবকাঠামো ব্যবহার করে। কিন্তু আমদানির জন্য ওই কোম্পানিগুলোকে সরকার নগদ প্রণোদনা দেয়।

পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, জ্বালানি তেল নিয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ২০১২ সালে একটি কমিটি গঠন করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। এই কমিটি পরীক্ষা করে বলেছে, বিপিসির আমদানি করা ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেলের মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঠিক আছে। যে কারণে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি তেলের বরাদ্দের (ইউনিটপ্রতি) পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। ফার্নেস অয়েল নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আর এগোননি বেসরকারি উদ্যোক্তারা। কিন্তু এখন তাঁরা বলছেন, আমদানি করা ফার্নেস তেলে সালফারের পরিমাণ (প্রতি ইউনিটে ৩.৫ শতাংশ) বেশি। এ জন্য কম সালফার (প্রতি ইউনিটে ২ শতাংশ) যুক্ত তেল আমদানির অনুমতি চান তাঁরা।

পিডিবি সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ বিভাগ সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের কাছে জানতে চায়, বিপিসি যে ফার্নেস অয়েল আমদানি করে তা আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না। এর জবাবে গত বছরের ১৫ জুলাই বিএসটিআই জানায়, বিপিসির আমদানি করা ফার্নেস অয়েলে সালফারের পরিমাণ ঠিক আছে। আর বেশি দাম দিয়ে কম সালফারযুক্ত ফার্নেস অয়েল আমদানি করলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়ে যাবে বলে জানান পিডিবির কর্মকর্তারা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানিতেও করমুক্ত সুবিধা চেয়েছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। মোট বিনিয়োগের অন্তত ১০ শতাংশ মূল্যের খুচরা যন্ত্রপাতি প্রতিবছর করমুক্ত সুবিধায় আমদানি করতে চান তাঁরা। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কেনা জমির রেজিস্ট্রি কর মওকুফ করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী কর-পূর্ব মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে রাখার বিধান রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এটি সংশোধনের দাবি জানান তাঁরা।

সার্বিক বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠনকনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে পিডিবির যে চুক্তি রয়েছে, এর বাইরে তাদের নতুন করে সুবিধা বাড়ানোর আইনত সুযোগ নেই। এটি করা হলে আইনের বরখেলাপ হবে, দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হবে।