সাড়ে ৪ বছরে ঢাকার রেলপথে ১৭ খুন

কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে একটি ট্রেন। সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: আসাদুজ্জামান
কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে একটি ট্রেন। সাম্প্রতিক ছবি। ছবি: আসাদুজ্জামান

পঞ্চগড়ের মাদ্রাসাশিক্ষার্থী আসমার লাশ ১৯ আগস্ট পাওয়া যায় কমলাপুর রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত শৌচাগারে। এই খুনের দায় স্বীকার করে এক কিশোর ঢাকার আদালতে বলেছে, ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রেখে সে পালিয়ে যায়। 

ঢাকার খিলক্ষেত খাঁপাড়া রেললাইনের ওপর আট বছর বয়সী মাদ্রাসাশিক্ষার্থী নাজমুলের লাশ পাওয়া যায় গত ১০ এপ্রিল। এই খুনের ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম বলেন, নাজমুল খুনের ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নিতে তার লাশ ফেলে রাখা হয় রেললাইনের ওপর।

রিকশাচালক সাইফুল মোল্লা আর নিরাপত্তারক্ষী হারুন মিয়া গত ২৩ এপ্রিল চিত্রা ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিলেন। জয়দেবপুরের আগে ধীরাশ্রম রেলস্টেশন এলাকায় এই দুজন যাত্রীর মালামাল কেড়ে নিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের (সিজিএম) সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, ঢাকা রেলওয়ে এলাকায় গত ৪ বছর ৭ মাসে ১৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত সীমানা নিয়ে ঢাকার রেলওয়ের থানা।

ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন। ছবি: আসাদুজ্জামান

প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত রেললাইন এলাকায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হচ্ছেন যাত্রীরা। আবার খুনের ঘটনাকে রেল দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার জন্য লাশ রেললাইনে রেখে যাচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির শিকার হয়ে যাত্রীরা বিচার চেয়ে রেলওয়ে থানায় মামলা করেছেন। সংঘবদ্ধ মাদক ব্যবসায়ীচক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ট্রেনে করে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য বহনের অভিযোগে মামলাও করছে পুলিশ।

ঢাকার রেলওয়ে থানার পুলিশও বলছে, যাত্রীদের ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করছে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। অন্যস্থানে খুন করে সেই খুনের ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা লাশ ফেলে রেখে যাচ্ছে রেললাইনের ওপর।

ঢাকার সিজিএম আদালতে দেওয়া রেলওয়ে থানার তথ্য বলছে, বিগত ৪ বছর ৩ মাসে খুনের ঘটনাসহ মামলা হয়েছে ৮২০টি। এর মধ্যে মাদকের মামলা ৫৯৭টি। অর্থাৎ, শতকরা হিসাবে ৭২ ভাগ মামলা মাদকসংক্রান্ত অপরাধের।

রেলপথে খুন
সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীচক্রের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন বেশ কয়েকজন ট্রেনযাত্রী। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর ভোরে টঙ্গী স্টেশন থেকে মোস্তফা নামের এক যুবক চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনে করে কমলাপুরে আসছিলেন। রাজধানীর বনানী এলাকায় আসার পর দুর্বৃত্তরা তাঁর মুঠোফোন ও ৬২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। পরে ট্রেন থেকে মোস্তফাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। স্থানীয় লোকজন মোস্তফাকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেদিন মারা যান তিনি। এ ঘটনায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রেলওয়ে থানায় মামলা করেন নিহত যুবকের বাবা আবু সিদ্দিক।

নিহত মোস্তফার ভাই মো. হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়ের মোবাইল ও টাকা কেড়ে নিয়ে ট্রেনের ছাদ থেকে ফেলে দেয় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন সন্দেহভাজন খুনিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

ঢাকার মগবাজার রেলক্রসিং। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকার মগবাজার রেলক্রসিং। ছবি: আসাদুজ্জামান

সিজিএম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য বলছে, চলতি বছর ঢাকা রেলওয়ে থানা এলাকায় খুন হয়েছেন তিনজন। গত বছর খুন হন পাঁচজন। এর মধ্যে বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় খুন হন দুজন। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ট্রেনস্টেশন এলাকায় খুন হন চারজন। ২০১৬ সালে তিনজন। ২০১৫ সালে দুজন।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুনিরা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য লাশ ফেলে রেখে যায় রেললাইনের ওপর। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন এলাকায় মস্তকবিহীন এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। আদালত সূত্র বলছে, খুনের শিকার ওই নারীর (২০) পরিচয় এখন পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। আদালতকে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, অন্য কোনো স্থানে খুন করে হত্যার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য ওই নারীর লাশ টুকরো টুকরো করে রেললাইনে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা।

গত বছরের ১৫ আগস্ট এক পুরুষের (৪০) লাশ উদ্ধার করা হয় টাঙ্গাইলের কালিহাতীর রাজবাড়ী রেললাইন এলাকায়। খুনের শিকার ওই পুরুষের পরিচয় এখন পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। আদালতকে পুলিশ প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছে, অন্য কোনো স্থানে ওই লোককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা লাশ রেললাইনে ফেলে রেখে যায়।

ঢাকার রেলওয়ে থানার সদ্যবিদায়ী ওসি ইয়াছিন ফারুক। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকার রেলওয়ে থানার সদ্যবিদায়ী ওসি ইয়াছিন ফারুক। ছবি: আসাদুজ্জামান

ঢাকার রেলওয়ে থানার সদ্যবিদায়ী ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ে পুলিশে জনবলসংকট প্রকট। ২০ বছর আগে তাঁর থানায় ৪৫ জন পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন। এখনো তা–ই আছে। সব মিলিয়ে পুলিশ সদস্য আছেন ৫৩ জন। জনবলসংকটের কারণে অনেক কিছুই করা সম্ভব হয় না।

ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ কথা সত্য যে খুন করে পেশাদার অপরাধীরা রেললাইনে লাশ রেখে যাচ্ছে। লাশ উদ্ধারের পর রেলওয়ে পুলিশ নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় উদ্ধারে সব ধরনের চেষ্টাই করে থাকে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। রেলওয়ে অপরাধ ঠেকাতে পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করছে।