সরকারি তালিকায় ৪২ হাজার নদী দখলদার

নদের সীমানা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে শিল্পকারখানা। সম্প্রতি বালু নদের পাড়ে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু–সংলগ্ন এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
নদের সীমানা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে শিল্পকারখানা। সম্প্রতি বালু নদের পাড়ে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু–সংলগ্ন এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

ছোট দোকান থেকে শুরু করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান—সবই আছে তালিকায়। কেউ সামান্য টিনের ঘর তুলে, কেউ বড় শিল্পকারখানা গড়ে তুলে দখল করেছেন দেশের নদ-নদী। এ তালিকায় মান্যগণ্য ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের নামও রয়েছে। দেশের নদ-নদী দখলদারদের প্রাথমিক তালিকায় এমন ৪২ হাজার ৪২৩ জনের নাম উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ওই তালিকা প্রকাশ করেছে। কমিশন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছেও এই তালিকা দিয়েছে।

দেশের প্রায় সব জেলায় এসব দখলকারী শুধু নদ-নদী নয়, খাল-বিলের জায়গাও দখল করেছে। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে স্থায়ী, অস্থায়ী নানা স্থাপনা। একেবারে ওয়ার্ড পর্যায় থেকে বড় শহর—সব জায়গায় খাল-নদীতেপড়েছে দখলদারদের থাবা। নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছে।

তবে এ তালিকা পরিপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নদী রক্ষা কমিশন বলছে, এ তালিকা আরও যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে কোনো দখলদারের নাম বাদ পড়েছে কি না। অবৈধ দখল উচ্ছেদে এক বছরের ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ নেওয়া হবে। যদিও এ জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই।

ঢাকা জেলা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ ১২টি জেলার দখলদারের তালিকা এখনো পায়নি নদী রক্ষা কমিশন। এমনকি অনেক জেলার তালিকায় সেখানকার সব নদ-নদীর দখলদারের তালিকা দেয়নি জেলা প্রশাসন। বাদ পড়া জেলার নদীর দখলদারদের তালিকা দ্রুত দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নদী রক্ষা কমিশন নির্দেশ দিয়েছে।

দখলদারদের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্থানীয় ব্যক্তি নদী-খাল দখল করে দোকানপাট, ঘরবাড়ি করেছেন। আর রাজধানীর উপকণ্ঠে শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদ-নদীতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান নদীর জায়গা দখল করে রেখেছে। দখলে জর্জরিত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ কর্ণফুলী নদী, চাক্তাই খালসহ দেশের প্রায় সব বড় নদ-নদী, খাল-বিল।

গত ১ জুলাই প্রকাশিত উচ্চ আদালতের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রায়ে সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা এবং নদ-নদী সুরক্ষায় নদী রক্ষা কমিশনকে এর আইনগত অভিভাবক ঘোষণা দেওয়া হয়।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমবারের মতো নদী-খাল-বিল দখলদারদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকেরা মূলত এ তালিকা করেছেন। এটি চলমান প্রক্রিয়া। এ তালিকা আরও যাচাই-বাছাই করা হবে। আরও দখলদার আছে কি না, সেটা দেখা হবে। তিনি বলেন, দখলদার উচ্ছেদে ইতিমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে। এক বছরের একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসন এটি করবে। এ জন্য তিনি পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে সরকারের কাছে দাবি জানান। তিনি বলেন, গত বছর সব জেলা মিলিয়ে উচ্ছেদ অভিযানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। এবার বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। সেটা পাওয়া যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন। সম্প্রতি কক্সবাজার জেলায় ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

শীতলক্ষ্যা দখল করে ডকইয়ার্ড ও বালুমহাল

দখলদারদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অনেকগুলো ডকইয়ার্ড। এর মধ্যে আছে সাউদিয়া, শেফা, সাউদ খান, আবুল হোসেন ও ইব্রাহিম ডকইয়ার্ড। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বগ্রামে হয়েছে মেটলাইফ, মেসার্স নাজির, মেসার্স মালিক ডকইয়ার্ডসহ ১৩টি অবৈধ ডকইয়ার্ড।

শীতলক্ষ্যা ভরাট করে চলছে বালুর ব্যবসা। রূপগঞ্জ অংশে নদী ভরাট করে বালুর ব্যবসা করছে এইচ আই ট্রেডার্স, মাসুম এন্টারপ্রাইজ, সালেক এন্টারপ্রাইজ, বিপ্লব এন্টারপ্রাইজ, বিউটি ও জসিম এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি অন্তত ৪ হাজার ৮০০ বর্গফুট নদী ভরাট করেছে বলে সরকারি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে কাঁচা-পাকা ঘর করে নদীর জায়গা দখল করে রেখেছেন আরও অনেকে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে নদী রক্ষায় একটি টাস্কফোর্স আছে। এটা ঢাকার চারপাশের নদী নিয়ে কাজ করত। এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব নদী নিয়ে কাজ করবে এই টাস্কফোর্স। ইতিমধ্যে এ নিয়ে বৈঠকও হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এর সঙ্গে অর্থ বরাদ্দের বিষয় জড়িত। তারপরও জেলা প্রশাসকদের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। অনেক জেলায় উচ্ছেদে কাজ শুরু হয়েছে।

তুরাগ-বালু নদে শিল্পকারখানা

রাজধানীর উপকণ্ঠ টঙ্গী-গাজীপুরের তুরাগ ও বালু নদের অংশও দখল হয়েছে। টঙ্গীতে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও অবৈধভাবে নদীর জায়গা দখল করে রেখেছে। আংশিক অস্থায়ী টিনের ছাউনি করেছে এননটেক্স। জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া এননটেক্স গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান। নামে–বেনামে ঋণ নিয়ে দেশের একক বৃহত্তম ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য আলোচিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। গ্রুপটির উদ্যোক্তা মো. ইউনুস (বাদল) সরকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

বালু ও মাটি দিয়ে ভরাট করে গাছ রোপণ করেছে জরিনা টেক্সটাইল। পাকা ও টিনের ছাউনির ভবন করেছে আনোয়ার গ্রুপ। কালীগঞ্জের মূলগাঁও মৌজায় শীতলক্ষ্যা দখল করে একটি অ্যাঙ্গেল শেড, সাতটি সেমি পাকা ভবন, তিনটি টিনের ছাউনির ঘর ও একটি ইটিপি প্ল্যান্ট করেছে ভরসা গ্রুপ। একই মৌজায় নদীর জায়গায় একটি অ্যাঙ্গেল শেড, দুটি সেমি পাকা ভবন, একটি পাকা ভবনের অংশবিশেষ।

মুন্সিগঞ্জের ফুলনদী ও মেঘনা নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন লিমিটেড। আর খালের জায়গা দখল করেছে নারায়ণগঞ্জ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড শিপ বিল্ডিং, সুপার বোর্ড মিল, সুপার ফরমিকা অ্যান্ড লেমিনেশন, সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, আনোয়ার জুট স্পিনিং মিলস, বেঙ্গল এনার্জি নামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আর মুন্সিগঞ্জ সদরের ইমামচর মৌজায় নদীর জায়গা দখল করেছে নুরে মক্কা মদিনা ব্রিক ফিল্ড, শাহ আলী ব্রিক ফিল্ড, দেলোয়ার ট্রেডার্স ব্রিক।

সমিতির নামে কর্ণফুলী দখল

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর জায়গা দখল করে আছেন অন্তত ৭৭৭ জন। এর মধ্যে বেশির ভাগই বাস্তুহারা সমবায় সমিতির নামে সমিতির সভাপতি ও সদস্যরা দখল করে আছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেমি পাকা ঘর তৈরি করা হয়েছে। আর কর্ণফুলী নদী ও এর আশপাশের সংযোগ খালের জায়গা দখল করে আছেন ২ হাজার ১১২ জন। নদীর জায়গায় আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মন্দির, বিভিন্ন বাহিনীর স্থাপনা। আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নে অবস্থিত কর্ণফুলী ডকইয়ার্ড এক্সটেনশন হিসেবে ব্যবহারের জন্য কর্ণফুলী নদীর অংশে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করেছে। নদীর অংশসহ জায়গার পরিমাণ তিন থেকে চার একর।

চট্টগ্রামের বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা চাক্তাই খালের বিভিন্ন জায়গায় দখল নিয়েছেন অন্তত ৫১ জন। খালের জায়গা দখল করে অনেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কেউ কেউ টিনের বেড়া দিয়ে জায়গা দখল করে রেখেছেন।

কক্সবাজারের বাকখালী নদীর ১২ একর মাছের ঘের করে দখল করেছেন ১০ জন। এর বাইরে ৪৮ জন মিলে এই নদীর ১৩ একর জমি বেড়ার ঘর ও খেতখামার দখল করে রেখেছেন। সাঙ্গু নদের ২৪৩ শতক জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন ২৮৫ জন দখলদার। পটুয়াখালীর লোহারিয়া ও লাউকাঠী নদীর জায়গা দখল নিয়েছেন ৩০১ জন। তাঁদের অনেকে মামলা করেছেন।

পাবনার ইছামতী নদী ও তীরবর্তী জায়গা দখল করে রেখেছেন ২৮০ ব্যক্তি। নদ-নদী, খালের পাশাপাশি বিলও দখলে চলে গেছে। রাজশাহীর তানোরে বিলকুমারীতে অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে ১০৯ জন। বিল শুকিয়ে যাওয়ায় ধান চাষের নামে দখলকারীরা বিলের জায়গা দখলে নেন।

নদী দখলের বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রথমবারের মতো নদ-নদী দখলকারীদের একটি তালিকা হলো, এটা ইতিবাচক ঘটনা। আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই তালিকা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে দেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারের উচিত হবে রাগ-অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে এবং কোনো বাছবিচার না করে এসব দখলদার উচ্ছেদ করা। শুধু তা-ই নয়, এসব দখলকারীর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত। মনে রাখতে হবে, নদী রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।