মা তো আসবে বলেছিল…

সোমা ঘোষ
সোমা ঘোষ

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শীর্ষ চৌধুরী ভালোবাসত পড়ালেখার ফাঁকে স্মার্টফোনে নানা গেমসে ডুবে থাকতে। তাই মা সোমা ঘোষ তাঁর মুঠোফোন ভরে রেখেছিলেন ছেলের পছন্দের নানা গেমসে। গেমস খেলার জন্য প্রতিদিন কবে মা স্কুল থেকে ফিরবেন—সেই অপেক্ষাতেই থাকত ছেলে। শেষবার যখন কথা হয়েছিল তখনো মা কথা দিয়েছিলেন ‘আসছি।’ কিন্তু সেই মা আর এল না। আসবেন না কোনো দিন।

এ জন্যই তো গতকাল রোববার ভরদুপুরে নগরের বলুয়ার দিঘি শ্মশানে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মায়ের দেহ দাহ করাতে গিয়ে কেঁপে উঠল এই কিশোরের মন। অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠল—মা তো আসবে বলেছিল। আসল না যে? এরপর থেমে গেল গলার স্বর। চোখ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়ছিল জল। স্বজনেরা তাকে সান্ত্বনা দেবেন কোথায়। নিজেরাই যে বাকরুদ্ধ, শোকস্তব্ধ। 

৩ আগস্ট বিকেলে নগরের শুলকবহর এলাকায় পেছন থেকে কাভার্ড ভ্যান ধাক্কা দিলে টেম্পো উল্টে নিহত হন রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমেনা বেগম। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে মারা যান একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জোবেদা খানম। এত দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন আরেক শিক্ষক সোমা ঘোষ। এই চোখ খোলেন তো, এই বন্ধ করেন—এভাবেই চলছিল তাঁর দিন। 

চোখ খোলা-বন্ধের এই খেলা চিরতরে থেমে গেল গতকাল ভোররাতে। ২২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে হেরে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন তাঁর আদরের বড় মেয়ে শ্রেষ্ঠা চৌধুরী আর ছেলে শীর্ষ চৌধুরীকে। সোমা ঘোষকে বাঁচাতে কম চেষ্টা করেনি পরিবার। দুর্ঘটনার দিন প্রথমেই তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দিন বিকেলেই একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। সেখান থেকে ১১ আগস্ট পুনরায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেই শেষ নিশ্বাস নেন তিনি।

একই দুর্ঘটনায় একে একে ঝরে পড়লেন দক্ষিণ নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক। তিন সহকর্মীকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ তাই অন্য শিক্ষকেরা। তাঁদের একজন অঞ্জনা চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই সহকর্মীকে হারানোর পর খুব আশায় ছিলাম সোমা দিদি অন্তত আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। তিনিও কথা রাখলেন না।’ 

সোমা ঘোষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন। প্রতিদিন নানা লেখা তুলে দিতেন ফেসবুকের পর্দায়। যার বেশির ভাগই ছিল দুই সন্তানকে ঘিরে। মেয়ের জন্মদিন পালনের ছবি দিয়ে গত ১৭ জুন ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন—‘১৬ জুন আমার কাছে অন্যতম স্মরণীয় দিন। কারণ এই দিনেই আমার কন্যা শ্রেষ্ঠা এসেছিল কোলজুড়ে।’ শ্রেষ্ঠার জীবনে ১৬ জুনটা হয়তো আরও অনেকবার আসবে। সেদিন শুধু থাকবে না উৎসবের মধ্যমণি হয়ে থাকা মা সোমা ঘোষ। তাই তো মাকে শেষবারের মতো দেখতে এসে নির্বাক শ্রেষ্ঠা জ্ঞান হারাচ্ছিলেন বারবার। মায়ের নিথর দেহ আঁকড়ে রাখতে চাইছিলেন খুব করে।

 একটা নিয়ম না মানা গাড়ির প্রতিযোগিতা যেন তিন শিক্ষকের ছয় সন্তানকে বাকি জীবনের জন্য বড় নিঃসঙ্গ করে গেল।