ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর কাজে আসছে না শিক্ষার্থীদের

রংপুরের বদরগঞ্জে ৮০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর, মডেম ও সিমসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বিতরণ করা হলেও তা শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব সরঞ্জাম অধিকাংশ শিক্ষক তাঁদের বাড়িতে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শায়লা জেসমিন সাঈদের সই করা এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫-১৮ সালে পিইডিপি-৩ প্রকল্পের আওতায় বদরগঞ্জ উপজেলার ১৭৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৮০টি বিদ্যালয়ে ১০৭টি ল্যাপটপ, ৫৬টি বিদ্যালয়ে ৬৪টি প্রজেক্টর এবং মডেম ও সিম বিতরণ করা হয়।

ওই শিক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে বড় পর্দায় (প্রজেক্টরে) কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের পাঠদান, মনোযোগ আকর্ষণ ও সহজে পাঠ রপ্ত করানো এবং স্কুলের যাবতীয় তথ্য ই-প্রাইমারি স্কুল সিস্টেমে প্রতিনিয়ত আদান–প্রদান করার উদ্দেশ্যে সরকার উপজেলার ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম বরাদ্দ দিয়েছে। বিতরণের আগে ওই বিদ্যালয়ের একজন করে শিক্ষককে ওই বিষয়ে প্রশিক্ষণও (আইসিটি ট্রেনিং) দেওয়া হয়েছে।

কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর বিতরণ করা হয়েছে, উপজেলার এমন ২৬টি বিদ্যালয়ে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একমাত্র বদরগঞ্জ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিশুদের পাঠদানের সত্যতা মিলেছে।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট পিইডিপি প্রকল্পের আওতায় উপজেলার বখশীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি ল্যাপটপ, স্কিপার, প্রজেক্টর, স্ক্রিন, পাওয়ার স্ট্রিপ, ব্যাগ, ইউএসবি ও মাউস বিতরণ করা হয়। গত ২৭ জুন ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সরঞ্জামগুলো বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে বাক্সবন্দী। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ বলেন, ‘আমার বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষককে আইসিটি ট্রেনিং দেওয়া হয়নি। এ কারণে সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করতে পারছি না।’

লক্ষ্মণপুর বুড়িরপুকুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট দুটি ল্যাপটপ, একটি প্রজেক্টরসহ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার জন্য সব ধরনের সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আতাউর রহমান এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে শিশুদের পাঠদান করা হয়নি। প্রধান শিক্ষক আহমেদুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ–সংযোগ না থাকায় এসব চালাতে পারছি না।’

আমরুলবাড়ি আসমতপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই দেওয়া হয়েছে একটি ল্যাপটপ। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণও নিয়েছেন সহকারী শিক্ষক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘প্রজেক্টর না দেওয়ায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নিতে পারছি না।’

জামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার মতো সব ধরনের সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে কখনো ক্লাস নেওয়া হয়নি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর হোসেন দাবি করেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার মতো বিদ্যালয়ে উপযুক্ত কক্ষ নেই। নিরাপত্তার অভাবে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর বিদ্যালয়ের দুজন সহকারী শিক্ষকের বাসায় রাখা হয়েছে।

চম্পাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট দুটি ল্যাপটপ ও একটি প্রজেক্টর বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রধান শিক্ষক মোখতারুল ইসলাম দাবি করেছেন, মডেম বরাদ্দ না পাওয়ায় বিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্লাস নেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে খোঁজ নিয়ে প্রযুক্তিগত পাঠদানের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

মুচিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি ল্যাপটপ, দুটি প্রজেক্টর, মডেমসহ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস নেওয়ার মতো সব ধরনের সরঞ্জাম দেওয়া হলেও এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে কখনো পাঠদান করা হয়নি। এসব সরঞ্জাম ওই বিদ্যালয়ে বিতরণ দেখানো হয়েছে ২০১৫ সালের ১১ মার্চ, ৭ ও ৯ জুলাই এবং ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট। কিন্তু ওই বিদ্যালয়ের অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর কখনো দেখেইনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দুলাল চন্দ্র বলেন, ‘বিদ্যালয়ে আমি একটি ল্যাপটপ বরাদ্দ পেয়েছি। তা আমার বাড়িতে রয়েছে।’ কিন্তু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বিদ্যালয়ে সরবরাহ করা দুটি ল্যাপটপ ও একটি প্রজেক্টর বরাদ্দের তালিকা দেখানো হলে তিনি বলেন, ‘আমি গত বছরের ৮ অক্টোবর এখানে যোগদান করে একটি ল্যাপটপই পেয়েছি।’ পরে তিনি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ডেকে দুটি ল্যাপটপ ও একটি প্রজেক্টর পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেন। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘একটি ল্যাপটপ ও একটি প্রজেক্টর দীর্ঘদিন ধরে স্কুলের পিয়ন আশরাফুল ইসলামের বাড়িতে রয়েছে।’

ওসমানপুর মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও কম্পিউটার ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ল্যাপটপ কখনো স্কুলে ব্যবহার করা হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শামিমা নাসরিন বলেন, বিদ্যালয়ের আগের প্রধান শিক্ষক ইশরাত জাহান কখনোই ল্যাপটপ স্কুলে আনেননি। তিনি গত জানুয়ারিতে দেড় বছরের জন্য একটি প্রশিক্ষণে গেছেন। এখনো ল্যাপটপটি তাঁর বাড়িতেই আছে।

উপজেলার বাকি ৫৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব বিদ্যালয়ে সরবরাহ করা ল্যাপটপ কিংবা প্রজেক্টর শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে আসছে না।

উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শায়লা জেসমিন সাঈদ বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যেসব ল্যাপটপ বিতরণ করা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই নষ্ট। এগুলো মেরামত করার বিষয়ে শিক্ষা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেছি। ভালো ল্যাপটপ প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিশুদের ক্লাস করানোর জন্য ইতিমধ্যে শিক্ষকদের তাগিদ দিয়েছি। এসব ব্যবহার করা না হলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চুরি যাওয়া রোধে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টরগুলো বিদ্যালয়ে না রেখে ছুটির পরে বাড়িতে এবং সকালে তা আবার স্কুলে নিয়ে আসার জন্য প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’