গাইবান্ধায় আমনের চারা-সংকট

গাইবান্ধার সর্বত্র আমন ধানের চারার সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। চারার অভাবে কৃষকেরা আমন রোপণ করতে পারছেন না। ফলে এ বছর আমন রোপণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে বর্তমানে উঁচু এলাকার কিছু হাটবাজারে সামান্য পরিমাণ চারা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চারার দাম অনেক বেশি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ১০ জুলাই থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত এবারের বন্যা স্থায়ী ছিল। এ কারণে পানিতে ডুবে থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে আউশ ও আমন বীজতলার। এ বছরের বন্যায় জেলার সাতটি উপজেলার মোট ৭ হাজার ৫১৯ দশমিক ৯০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রোপা আমন ৩১ হেক্টর, আমন বীজতলা ২ হাজার ৪৭১ দশমিক ৫০ হেক্টর, আউশ ধান ২ হাজার ৩৮৮ দশমিক ৪০ হেক্টর। সূত্রটি আরও জানায়, বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ বছর ১ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। গতকাল রোববার পর্যন্ত চাষ হয়েছে ৬৯ হাজার ৩১১ হেক্টর। 

১৫ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন চাষের উপযুক্ত সময়। কিন্তু চারার অভাবে আমন রোপণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে উঁচু এলাকার কিছু হাটবাজারে আমন চারা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দাম অনেক বেশি। প্রতি ৮০ আঁটি আমনের চারা ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ বন্যার আগে বিক্রি হতো মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এক বিঘা জমির জন্য ৩২০ আঁটি দরকার। 

গতকাল সকালে গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাদুল্যাপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, কৃষকেরা জমি তৈরি করে বসে আছেন, চারার অভাবে রোপণ করতে পারছেন না। গাইবান্ধা সদর উপজেলার গোঘাট গ্রামের কৃষক সাদ্দাম হোসেন (৪৮) বলেন, ‘জমি চাষাবাদ করে ছয় সদস্যের সংসার চলে। পরিবারে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী নেই। এ বছর তিন বিঘা জমি চাষাবাদ করি। যে ফসল পাই, তা দিয়ে খাওয়া, সংসার চলে। কিন্তু এবার বন্যায় আমার তিন বিঘা রোপা আমন বন্যায় নষ্ট হয়। ধারদেনা করে পুনরায় জমি তৈরি করেছি। কিন্তু চারার অভাবে রোপণ করতে পারছি না।’ ওই গ্রামের কৃষক সিদ্দিক মিয়া (৬০) বললেন, ‘হামার চার বিগে জমির ধান, বেছন (বীজতলা) ডুবি থাকি নষ্ট হচে। হামরা কিরসোক মানুষ। নয়া করি ধান নাগামো ক্যামন করি। নিজে চারা কিনব্যার পাই নাই, সোরকার থাকি দ্যায় নাই।’

ফুলছড়ির রতনপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব জামাল শেখ বললেন, ‘জমিগুলে ছাড়া হামারঘরে আয়ের পত নাই। হামরা ধানের ভাত খাই, কোসটা (পাট) বেচি দায়দ্যানা মিটাই। কিনতো বানের পানি হামারঘরে সগকিচু কারি নিচে। একন চারার জন্নে জমি পরি আচে। কিনতো সোরক্যার চারা সার কিচুই দিলো না।’

গতকাল দুপুরে সাদুল্যাপুর উপজেলা শহরের চারা বিক্রির হাটে গিয়ে দেখা গেছে, সাদুল্যাপুর উপজেলার বদলাগাড়ি গ্রামের কৃষক আশরাফুল আলম (৪৫) বলেন, ‘এবার দেড়বিঘা জমি বর্গা নিয়ে আমন চাষ করি। কিন্তু বন্যায় ধানগাছ নষ্ট হয়েছে। কষ্ট করে জমি তৈরি করলাম। চারার অভাবে লাগাতে পারছি না। আজ (রোববার) এই হাটে চারা কিনতে এসেছি। কিন্তু বিক্রেতারা দাম বেশি চাচ্ছেন। টাকা কুলায়নি, তাই কিনতে পারলাম না।’ 

একই গ্রামের কৃষক হাফিজার প্রধান (৬০) বলেন, ১১ হাজার টাকা খরচ করে তিন বিঘা জমিতে ধান লাগাই। কিন্তু বন্যায় নষ্ট হয়েছে। ৯ হাজার টাকা ঋণ করে হাটে এসেছি। এসে দেখছি ধানের চারার দাম তিন গুণ। শেষ সময়ে বেশি টাকা দিয়ে চারা কিনে তেমন লাভ হবে না, তাই বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম ফেরদৌস মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ একর জমিতে কমিউনিটি আমন বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। এই বীজ দিয়ে ২ হাজার ৫০০ একর জমিতে আমন ধান রোপণ করা যাবে। কৃষক উপকৃত হবে ৭ হাজার ৫০০ জন। এ ছাড়া ৫৬টি ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে। এ বীজতলা থেকে আট হেক্টর জমিতে চারা রোপণ করা যাবে। তিনি আরও বলেন, বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের মাস কালাইসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন রোপণের উপযুক্ত সময়। এ সময়ের মধ্যে গাঞ্জিয়া, নাজির সাইল, গুটি স্বর্ণা জাতের ধান চাষ করলে ফলন ভালো পাওয়া যাবে।