শরতের শাপলার খোঁজে

ফোটার অপেক্ষায় শাপলাকলি। গতকাল জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে।  ছবি: প্রথম আলো
ফোটার অপেক্ষায় শাপলাকলি। গতকাল জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। ছবি: প্রথম আলো

‘গতকাল রাতে হঠাৎ মনে পড়েছে আমার ছেলেবেলাকার কথা। দাদুর সঙ্গে আলপথ ধরে সেই নদীর পাড়। সেই গাবগাছ। ঘাটে বাঁধা থাকত আমাদের ছোট ডিঙি। সেই নৌকা বেয়ে শরতে প্রায় প্রতিদিন ধনাগোদা নদীর বুকে ভেসে ভেসে শাপলা তোলা। বাবা বাজার থেকে কিনে আনতেন ছোট চিংড়ি। মা শাপলার কচি ডগা দিয়ে চিংড়ি ভাজতেন। দুপুরে গরম ভাতের সঙ্গে পাতে পড়ত তা। আহা সেই স্বাদ! এখনো মুখে লেগে আছে।’ বলছিলেন মিরপুরের গুদারাঘাটের বাসিন্দা লায়লা খালেদ।

শৈশবের সেই সুখস্মৃতি স্মরণ করে গতকাল রোববার সকালে শাপলা খুঁজতে এসেছিলেন তিনি  রাইনখোলা কাঁচাবাজারে। গুদারাঘাটের পাশেই তাঁর বাড়ি। গুদারাঘাট কাঁচাবাজারে শাপলালতা পাননি। অনেকটা পথ হেঁটে রাইনখোলা কাঁচাবাজারে খুঁজছিলেন শাপলালতা। এখানেই পথের ধারের সবজি বিক্রেতার কাছে শাপলার আঁটি পেয়ে খুব খুশি। চটপট চার আঁটি শাপলা থলেতে পুরে নিলেন। যাওয়ার আগে জানালেন শাপলার এই ডগা দিয়ে হরেক পদের মজাদার রান্না হয়। শুধু সরষে দিয়ে শাপলার ডগা, চিংড়ি দিয়ে চচ্চড়ি কিংবা ইলিশের সঙ্গে শাপলার মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয় অন্য রকম স্বাদ।

হরেক রকম সবজির সঙ্গে শাপলা বিক্রি করছিলেন মোহাম্মদ দিদার। ১০ থেকে ১২টি শাপলা একত্র করে একটি আঁটি বাঁধা হয়েছে। প্রতি আঁটি ১৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। মিরপুর ১ নম্বর পাইকারি কাঁচাবাজারে ভোরে বিক্রি হয় শাপলাডগা। সিলেট ও হবিগঞ্জের বড় বড় বিল থেকে এসব সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সকাল সকাল এমন শাপলা নিয়ে রান্নার ফিরিস্তি শুনে ইচ্ছে হলো এই শুভ্র শরতে বিল-ঝিলের টলটলে পানিতে দুলতে থাকা সফেদ শাপলার চোখজুড়ানো দৃশ্যটি দেখার। কিন্তু সে সুযোগ এই নগরীতে নেই। বিকল্প হতে পারে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের জলাধার। রাইনখোলার প্রধান সড়ক ধরে একটু এগোলেই জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। প্রবেশপথ পেরিয়ে উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোতেই প্রকৃতিতে শরতের আগমন বেশ স্পষ্ট হয়েই ফুটে উঠল চোখের সামনে। এখানে উঁচু দালানকোঠার আড়াল নেই। ওপরের দিকে তাকালেই চোখে পড়ছে ঘন নীল আকাশ। তার বুকে উড়নচণ্ডী ধবল মেঘের দল আলস্যে ভাসছে। উদ্যানের অনুপম নিসর্গজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ঝলমলে রোদের মেজাজটি অবশ্য একটু কাড়া। তবে ছায়ায় ছায়ায় এগিয়ে যেতে তেমন অসুবিধা হয় না।

উদ্যানের পুকুরগুলোয় আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও প্রস্ফুটিত সাদা শাপলার দেখা পাওয়া গেল না। তার বদলে আছে অজস্র লাল শাপলা। উদ্যানের মালি এখলাস মিয়া জানান, ঢোকার মুখে গোলাপবাগানের চৌবাচ্চায় থাকতে পারে। অবশেষে সেখানে গিয়ে দেখা মিলল এই জাতীয় ফুলটির। তবে ফুটন্ত নয়। সাদা শাপলার কলি এসেছে চারটি। ফুল হয়ে ফোটার অপেক্ষায় পানিতে দুলছে কলিগুলো।

শরৎকালে আকাশের শুভ্র মেঘের দল, নদীতীরের সফেদ কাশবন, ভোরের শিউলি আর বিল-ঝিলে প্রস্ফুটিত শাপলার শোভায় শুচিস্নিগ্ধ হয়ে ওঠে বাংলার প্রকৃতি। এটি পদ্মগোত্রের। এক স্তবকে থাকে কয়েকটি পাপড়ি। তার মাঝখানে থাকে পরাগধানী, পরাগ, কেশর ইত্যাদি। বড় পুকুর, বিলে-ঝিলে ফুটলে সাধারণত শাপলার লতাগুলো দেখা যায় না। তবে চৌবাচ্চায় শাপলার লতাগুলো দেখা যাচ্ছিল। বাংলাপিডিয়ায় আছে শাপলা জলজ নিমফিয়া গণের জলজ প্রজাতির উদ্ভিদ। এ উদ্ভিদের পাতা বড়, গোলাকার, ভাসমান এবং ফুল দৃষ্টিনন্দন। শাপলার প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৫০। বাংলাদেশে সাদা, লাল ও নীল—এই তিন রঙের শাপলা দেখা যায়। এর মধ্যে সাদা শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। এর লতা সবজি হিসেবে জনপ্রিয়। সারা বছরই শাপলা ফোটে তবে বর্ষা ও শরতে প্রস্ফুটন বেশি।