মাল্টার 'মায়াকানন' স্বপ্ন হলো পূরণ

নিজের মাল্টা বাগানে রিনা আক্তার। সম্প্রতি নওগাঁর আঙ্গরত তেলিপাড়া গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
নিজের মাল্টা বাগানে রিনা আক্তার। সম্প্রতি নওগাঁর আঙ্গরত তেলিপাড়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

বাবা ছিলেন কৃষি বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তাঁর বাগান করার খুব ইচ্ছা ছিল। বড় বাধা ছিল একটাই—চাকরিটা বদলির। তবু যখন যেখানে গেছেন, সুযোগমতো বাগান করেছেন। বাগানে নানান ধরনের ফুল ও ফলের গাছ লাগাতেন। বাবার ইচ্ছাটা পেয়ে বসে মেয়ে রিনা আক্তারেরও। ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল নিজের একটি ফলবাগান গড়ে তোলার।

বরেন্দ্রভূমি নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায় মাল্টাবাগান গড়ে তুলে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন রিনা আক্তার (৪৫)। ধামইরহাট সদর ইউনিয়নের আঙ্গরত তেলিপাড়া এলাকায় নিজের ৫০ শতাংশ জমিতে বাসভবন, পাশে এই বাগান। রিনা আক্তার তাঁর বাগানের নাম দিয়েছেন ‘মায়াকানন’। আজ সেই বাগানে চাষ করা মাল্টার বদৌলতে এলাকায় একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। আসন্ন মৌসুমে বাজারে উপযুক্ত দাম পেলে লাভের আশা করছেন রিনা।

সম্প্রতি রিনার মাল্টাবাগানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট গাছে ঝুলছে থোকা থোকা মাল্টা। একেকটি গাছে ১৫-২০টি করে মাল্টা ধরেছে। গাঢ় সবুজ রঙের মাল্টাগুলোর কোনো কোনোটিতে হলুদাভ ভাব এসেছে।

রিনা আক্তার বলেন, বাবার সঙ্গে থেকে গাছের সঙ্গে পরিচিতি। বিয়েও হয়েছে একজন কৃষিবিদের সঙ্গে। স্বামী জামাল উদ্দিন বর্তমানে গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক। পারিবারিক নানা ব্যস্ততার কারণে এত দিন তাঁর বাগান করার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।

দুই বছর আগে স্বামীর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় বাসভবনের পাশে ৫০ শতাংশ জমিতে বারি মাল্টা-১ এর চারা রোপণ করেন রিনা। ১০ ফুট পরপর মোট ১৫০টি চারা রোপণ করেন। এবার বাগানের প্রায় সব গাছেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় মাল্টা ফল ধরেছে। মাল্টাগুলো এখন পরিপক্ব হয়ে উঠেছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ফল সংগ্রহ শুরু হবে।

রিনা আক্তার বলেন, গাছপ্রতি ১০ থেকে ১২ কেজি পর্যন্ত মাল্টা ফল পাওয়া যাবে। বাজারে বর্তমানে পাইকারিতে মাল্টা ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে কেনাবেচা হচ্ছে। ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে পারলেও প্রতিটি গাছ থেকে অন্তত এক হাজার টাকা করে পাওয়া যাবে। সে হিসাবে ১৫০টি গাছ থেকে অন্তত দেড় লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

>

বাড়ির পাশে ৫০ শতাংশ জমিতে মাল্টার বাগান করেছেন রিনা আক্তার। এই বাগানই তাঁকে একজন সফল নারী উদ্যোক্তার পরিচিতি এনে দিয়েছে।

মাল্টা চাষে রিনার খুব বেশি খরচ হয়নি। ১৫০ টাকা দরে তিনি একেকটি চারা গাছ কিনেছিলেন। তাতে দাম পড়েছিল ২২ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া মাল্টাবাগান গড়ে তুলতে এককালীন ব্যয় হয় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। পরে শ্রমিকের মজুরি ও অন্য খরচ বাবদ মোট ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ করেছেন। সব মিলিয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে তাঁর। নিজের উদ্যোগ রিনাকে করে তুলেছে আরও আত্মবিশ্বাসী। মাল্টার বাইরে ড্রাগন ফল চাষের ব্যাপারেও আগ্রহ রয়েছে তাঁর।

স্বামী জামাল উদ্দিন বলেন, ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে যাওয়ার পর রিনার ব্যস্ততা কিছুটা কমেছে। জীবনের মাঝবয়সে তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে চলেছে। এই বাগান নিয়ে রিনা এখন অনেক খুশি। বাণিজ্যিক সফলতার প্রত্যাশার পাশাপাশি বাড়ির পাশে এমন বাগান দেখে খুবই ভালো লাগে।

উপজেলা কৃষি বিভাগ বলছে, ধামইরহাটের মাটি যেকোনো ধরনের ফল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। এই অঞ্চলের মাল্টা ও ড্রাগন ফলের মিষ্টতা ও গুণাগুণ অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভালো। বাজারে এসব ফলের ভালো দামও পাওয়া যায়। অথচ সচেতনতার অভাবে এই অঞ্চলের মানুষ শুধু ধান চাষে ব্যস্ত থাকে। বর্তমানে ধান চাষে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে এলাকার চাষিদের লাভজনক ফলবাগান গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, রিনা আক্তারকে মাল্টা ও ড্রাগন ফল চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর বাগানে মাল্টার প্রদর্শনী দেওয়া হয়েছে। সরবরাহ করা হয়েছে উন্নত মানের মাল্টা চারা বারি-১। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত রিনাকে নানা রকম পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এলাকার বেকার অনেক যুবকই রিনার বাগান দেখে ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।