বন্দুকযুদ্ধ, হয়রানি, ভাঙচুর আর গুমের নেপথ্যে

ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি
ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মোস্তফাকে টেকনাফ থানার পুলিশ ধরে নিয়ে যায় গত ২৭ মে। তারপর তিন দিন পুলিশ তাকে নিয়ে হোয়াইক্যংয়ের সাতঘড়িয়াপাড়ায় তার বাড়িতে ইয়াবা ও অস্ত্র খুঁজতে ফিরে আসে, কিছু পায় না। চতুর্থ দিন এসে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বলে, পাশের বাড়ির মফিজ আলমের বিছানার নিচ থেকে ইয়াবা আর অস্ত্র বের করে দিয়েছে মোস্তফা।

সাতঘড়িয়াপাড়ার অন্তত ১৬ জন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেছেন, হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির কয়েকজন সদস্য আগে পাড়ায় এসে তাঁদের সরিয়ে দিয়ে প্রতিবেশী মফিজের বাড়ি ঘিরে ফেলেছিলেন। মোস্তফাকে নিয়ে থানার পুলিশ আসে পরে। কিছুক্ষণ পর মোস্তফার হাতে ইয়াবা আর অস্ত্র দিয়ে পুলিশ সাংবাদিকদের ডাকে, ছবি তোলে।

মোস্তফা, মফিজ ও গ্রামবাসী কৃষক মো. হোছেনকে আসামি করে পুলিশ টেকনাফ থানায় ইয়াবা পাচার ও অস্ত্র মামলা দেয়। মোস্তফাকে পুলিশ আদালতে তোলে ১ জুনে। সে এখন জেলে। হোছেন গত ২০ জুলাই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। মফিজ পলাতক।

দেশে চলমান মাদকবিরোধী ‘সর্বাত্মক’ অভিযানের একটি বড় ক্ষেত্র কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেলায় ৭৩ জন ইয়াবা গডফাদারের তালিকা করেছিল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁদের ২৯ জনসহ ১০২ জন ইয়াবা কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। প্রায় সবাই টেকনাফের।

জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে জনপদটি ছিল আতঙ্কে থমথমে। আত্মসমর্পণের পর ছয় মাসে টেকনাফে পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মাদক কারবারি সন্দেহভাজন ৫৫ জন নিহত হয়েছেন। গডফাদারের তালিকাভুক্ত মাত্র একজন। কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা মূলত মাদকের বাহক। থানার সূত্র বলছে, এ সময় শুধু ইয়াবাসংক্রান্ত মাদক মামলাই হয়েছে ৫৫০টি।

প্রথম আলো কক্সবাজার, টেকনাফ পৌরসভা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি আর ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীসহ শতাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা বলেছেন, অনেক নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। কোনো কোনো কর্মকর্তা ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে বা মামলায় ফাঁসিয়ে টাকা আদায় করছেন। সাজানো বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, শতভাগ ক্ষেত্রেই প্রকৃত বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। আর টেকনাফ-উখিয়ার সাংসদ শাহিন আক্তার বলেছেন, পুলিশের বাড়াবাড়ির কোনো অভিযোগ পাননি। তিনি এই আসনের সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান ওরফে বদির স্ত্রী।

পুরুষশূন্য সাতঘড়িয়াপাড়া
গত ২৩ জুলাই পশ্চিম সাতঘড়িয়াপাড়ার একটি ছোট দোকানঘরে সাংবাদিক পরিচয়ে বসে যাঁদের সঙ্গে কথা হয়, তাঁদের অনেকে সম্প্রতি মাদক মামলার আসামি হয়েছেন। নম্বরপ্লেটবিহীন গাড়ি ও অচেনা লোক দেখলেই এঁরা এখন পাহাড়ে লুকান।

এই গ্রামের মো. হোছেন গত ২০ জুলাই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। হোছেনের ভাই মো. কাশেমও এপ্রিলে একইভাবে মারা গিয়েছিলেন। ২৩ জুলাই একটা ছোট টিলার ওপর ধসে যাওয়া মাটির ঘরের সামনে বসে কথা বলেন হোছেনের স্ত্রী সানজিদা বেগম। পাশে কাশেমের স্ত্রী দিলু আরা। অদূরে এক বৃদ্ধা মাতম করে চলেন, ‘আমার ফুতাইনরে! আমার ফুতাইন...’

পরিবারটির আসবাব বলতে একটিমাত্র খাট ছিল। সেটার তোশক কোপানো, কাঠ ভাঙা। সানজিদা বলেন, পুলিশ তল্লাশির সময় ভাঙচুর করেছে। সদ্য বিধবা মেয়েটি বলেন, তাঁর স্বামী হালচাষ করতেন। সেদিন দুপুরের দিকে খেতের কাজ শেষে চাচার বাসায় ভাত খেতে বসেছিলেন। এক গ্রাস মুখে তোলার আগেই সাদাপোশাকে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়।

পরদিন ভোরে গ্রামের চৌকিদার ফোন করে জানান, কক্সবাজার হাসপাতালে হোছেনের লাশ আছে। এক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে বলেন, পথের ধারে গামলা পেতে টাকা তুলে পরিবার আর এলাকার মানুষেরা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে যান। ওই ‍টাকায় অ্যাম্বুলেন্সে করে মো. হোছেনের লাশ বাড়িতে আসে।

>

মাদকবিরোধী অভিযানের একটি বড় ক্ষেত্র কক্সবাজারের টেকনাফ
আত্মসমর্পণকারী ১০২ জন ইয়াবা কারবারির প্রায় সবাই টেকনাফের
আত্মসমর্পণের পর ৬ মাসে বন্দুকযুদ্ধে ৫৫ জন নিহত হয়েছেন
মাদকবিরোধী অভিযানে অনিয়ম ও চাঁদাবাজির অভিযোগ

তিন মাস আগে চৌকিদারের ফোনেই হোছেনের ভাই কাশেমের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার খবর এসেছিল। গত ৩১ মার্চ হ্নীলায় মাদক ব্যবসায়ী সন্দেহে আটককৃত মাহমুদুর রহমান কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলে পুলিশ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা করে। কাশেম ছিলেন এই মামলার আসামি।

এর আগে কাশেমের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে কোনো মামলা ছিল না। আত্মীয়স্বজন আর গ্রামের মানুষজন বলছেন, কাশেম-হোছেনদের পরিবারের সঙ্গে এলাকার মো. আলম ওরফে বাবুল আর তাঁর ভাই আওয়ামী ওলামা লীগের নেতা মৌলভি বদিউল আলমের জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল। পুলিশ বাবুলদের পক্ষ নিয়েছে। এ প্রতিবেদক বাবুলের বাসায় গিয়েও তাঁকে পাননি।

মো. হোছেনের বিরুদ্ধে অতীতে গ্রাম্য মারপিটের মামলা হয়েছিল। তিনি জামিনে ছিলেন। তাঁর আইনজীবী বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আবদুস শুক্কুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার সময় আমি ওকে বাড়ি ফেরার খরচটা দিতাম। এক বেলা খাবার জুটলে অন্য বেলা জোটে না। হোছেন চাষবাস করত, আর তার ভাই কাশেম বাগান পাহারা দিত।’

এদিকে কাশেম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর তিনটি মামলা হয়। হত্যা, অস্ত্র ও মাদকের সেই মামলাগুলোয় আসামি হন মো. ফিরোজ আলমসহ ১৯ জন। ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, সাত বছর আগে তিনি ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের নভেম্বরে অল্প কিছু টাকাপয়সা নিয়ে দেশে ফিরে ছোট্ট একটা ঘর তুলেছেন, বিয়ে করেছেন। এখন পালিয়ে পালিয়ে থাকেন।

ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি আমি কখনো ইয়াবা বিক্রি করে থাকি, আমাকে গুলিতে দেন। না হলে তদন্ত করেন। আমি তদন্তে হেলেপ (হেল্প—সাহায্য) করব। এভাবে আর পারি না।’ এই মামলার আরেক আসামি নয়াবাজার উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আবছার উদ্দীনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

এই মামলার এজাহার বলছে, ১১ এপ্রিল রাতে ‘বহু মামলার পলাতক আসামি ও ইয়াবা ব্যবসায়ী জনৈক মো. কাশেম’ হোয়াইক্যং নয়াবাজারের কাঁচাবাজারে ‘বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট কেনাবেচার জন্য অপেক্ষা করছিলেন’ বলে পুলিশের কাছে তথ্য ছিল। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে কাশেম ধরা পড়েন। তিনি বলেন, তাঁরা মিয়ানমার থেকে নদীপথে ইয়াবা এনে সাতঘড়িয়াপাড়ায় ইছহাক মাস্টারের মাছের ঘেরে জমা রেখে সারা দেশে পাঠান।

এজাহার অনুযায়ী, মজুত ইয়াবা ও অস্ত্র দেখানোর জন্য পুলিশ কাশেমকে সেখানে নিয়ে গেলে তাঁর সহযোগীরা পুলিশের দিকে গুলি ছোড়েন। কাশেম ‘গুলিবিদ্ধ হন’। হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রথম আলোর দেখা সব কটি বন্দুকযুদ্ধ-এজাহারের বয়ান প্রায় হুবহু এ রকম।

এ গ্রামেরই সদ্য ১৮ বছর বয়সী আবদুর রহমান পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন গত ১১ মার্চ। তিনি হিফজুল কোরআন আদর্শ ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় হেফজ শেষে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর মা শামসুন্নাহার নিরাপত্তার জন্য এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

শামসুন্নাহারকে খুঁজে পেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার ১২ দিন আগে রহমান এক বন্ধুর সঙ্গে হ্নীলা বাজারে গিয়েছিলেন। বন্ধুটিই ফোন করে তাঁকে বলে, পুলিশ রহমানকে থানায় নিয়ে গেছে। থানায় যোগাযোগ করলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা এ কথা অস্বীকার করেন। পরে চৌকিদারের ফোনে জানতে পারেন, ছেলে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।

ছেলের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো মামলা ছিল বলে শামসুন্নাহারের জানা নেই। পরে শুনেছেন, তাঁর দেবর ও জা চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ ধরা পড়েছিল। সেই মামলায় পুলিশ রহমানকে পলাতক আসামি হিসেবে দেখিয়েছে।

সাতঘড়িয়াপাড়া থেকে কিছুদূর এগোলে কানজরপাড়া। এ গ্রামের জিয়াউর রহমান, তাঁর স্ত্রী বেবি আক্তার আর তাঁদের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে এখন কারাগারে। জনশূন্য বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে মেয়েটির খেলার সাথি আর পরিবারটির ঘনিষ্ঠজনেরা আসেন। তাঁরা বলেন, গত ১৩ জুলাই পুলিশ পুরোনো একটি মাদক মামলার আসামি জিয়াউরকে গ্রেপ্তার করতে আসে। মেয়ে বাধা দিলে পুলিশ তাকে গাড়িতে তোলে। পরে মাকেও গ্রেপ্তার করে।

মামলার এজাহারে মেয়েটির বয়স লেখা হয়েছে ১৯। মা-মেয়ে মাদক ব্যবসা করছিল। মেয়েটি নিজেই ‘বুকের ভেতর থেকে’ কালো পলিথিনে মোড়ানো ১০টি নীল রঙের ইয়াবার প্যাকেট পুলিশকে বের করে দেয়। প্রতিটি প্যাকেটে ২০০ ইয়াবা বড়ি ছিল।

হত্যা আর হয়রানি
কথিত বন্দুকযুদ্ধের ১০টি এজাহার খতিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ তিন থেকে চারটি করে মামলা করেছে। হত্যা, মাদক ও অস্ত্র এবং পুলিশের ওপর হামলা বা সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে মামলা হয়েছে। একেকটিতে নামে আসামি আছে ১২ থেকে ২৮ জন। অজ্ঞাতনামা তো আছেই।

এপ্রিল, মে ও জুন মাসে বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফ থানার মোট ১৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার তথ্য রয়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই আঘাতের ধরন লেখা নেই। তাঁদের মধ্যে তিনজন এক মাসের ব্যবধানে দুবার আহত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন।

গত ১৯ মার্চ পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ইয়াবার হুন্ডি ব্যবসায়ী ইয়াসিন আরাফাত নিহত হন। পুলিশ ২১ জনকে নামে আসামি করে মামলা দেয়। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন ভাই। পরিবারের সদস্যরা প্রথম আলোকে বলেছেন, পুলিশ সদস্য পরিচয়ে একজন ফোন করে দুই ভাইয়ের প্রাণ বাঁচানোর জন্য টাকা চাইলে তাঁকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন।

কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের এক সহযোগী সংগঠনের একজন শীর্ষ নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনটি ঘটনায় এমন গ্রেপ্তারের পর সম্ভাব্য ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ঠেকানোর জন্য স্বজনেরা তাঁর সাহায্য চেয়েছেন। তিনি তখন টেকনাফ থানা পুলিশের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে আলোচনা চালিয়েছেন।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, কোনো রকম অনিয়ম বা পক্ষপাত করে অভিযান চালানো হচ্ছে না। তাঁর থানা দুর্নীতিমুক্ত। ইয়াবা কারবারিদের বাড়িঘরে কোনো হামলাও পুলিশ চালাচ্ছে না।

হামিদা বেগম, মো. মোস্তফা, মো. হোছেন, মো. কাশেম
হামিদা বেগম, মো. মোস্তফা, মো. হোছেন, মো. কাশেম

৭৩ জন ইয়াবা গডফাদারের তালিকায় সাবেক সাংসদ বদির পরই সাইফুল করিমের নাম। গত ২ মে তাঁর দুই ভাই মাহবুবুল করিম ও রাশেদুল করিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন সাইফুল আত্মসমর্পণ করার জন্য মিয়ানমার থেকে ফিরলে ৩১ মে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পুলিশ তারপর তাঁর দুই ভাইকে রিমান্ডে নেয়। স্বজনেরা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এই দুজনের প্রাণভিক্ষা চেয়ে পুলিশকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন।

মাহবুবুল করিম টেকনাফ স্থলবন্দরে বাঁশ-কাঠসহ আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করতেন। তাঁর ছোট ভাই রাশেদুল করিম এনজিও কেয়ার বাংলাদেশের কর্মকর্তা ছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের করা মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকাগুলোর কোনোটিতেই তাঁদের নাম নেই। তবে গ্রেপ্তারের আগে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোয়, রাশেদুল ইয়াবা কারবারে জড়িত। গত ২৯ এপ্রিল বিবৃতি দিয়ে কেয়ার বলে, তারা নিশ্চিত, রাশেদুল মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন।

গত ২১ জুলাই সাইফুল করিমের পৈতৃক বাড়িতে গেলে ব্যাপক ভাঙচুরের নমুনা দেখা যায়। বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য ছিলেন না। জড়ো হওয়া মানুষজন বলেন, সাইফুলের ভাইদের গ্রেপ্তার করতে আসা সাদাপোশাকের পুলিশ এই ভাঙচুর করেছে। পরে পোশাকি পুলিশ এসে আঙিনার মাটি খুঁড়ে ইয়াবা জব্দ করে।

তিন দিন পর ‘বন্দুকযুদ্ধ’
গত ১৭ জুলাই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন হামিদা বেগম (৩২)। টেকনাফ থানায় ওই দিন মামলা দিয়ে এজাহারে পুলিশ বলে, তিনি টেকনাফ থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে সারা দেশে পাচার করতেন বলে ‘ব্যাপক জনশ্রুতি’ আছে। ইয়াবার ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে তাঁর প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে গোলাগুলিতে হ্নীলার জাদিমুড়ায় হামিদা নিহত হন। পুলিশ জানতে পেরেছে, তাঁর বিরুদ্ধে ১৩ জুলাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছিল।

তবে হামিদার মা দিলদার বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ওই রাতেই এক দল পুলিশ সাদাপোশাকে তাঁর মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল। পরদিন সকালে হামিদার বাবা সোনা আলী টেকনাফ থানায় মেয়েকে দেখেছেন। কিন্তু পুলিশ বাবা-মাকে বলেছিল, হামিদা থানায় নেই। ১৭ জুলাই ভোরবেলা গ্রামের চৌকিদার ফোন করে তাঁদের জানান, হামিদার লাশ কক্সবাজার সদর হাসপাতালে।

হ্নীলায় হামিদা তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে বাবা–মায়ের বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটা মাটির ঘরে থাকতেন। দিলদার বেগম বলছেন, চাল–ডাল বিনা মূল্যে পাওয়ার আশায় মেয়ে রোহিঙ্গা পরিচয় দিয়ে কার্ড করিয়েছিলেন। তাঁর প্রশ্ন, দেশে আইন–আদালত থাকতে তাঁর মেয়েকে বিনা বিচারে মরতে হলো কেন?

আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেছেন, ত্রাস সৃষ্টি করে মাদক নির্মূলের যে কৌশল নেওয়া হয়েছিল, সেটার কার্যকারিতা যাচাই করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

ঢাকায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, বেআইনি ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে প্রশ্রয় দেওয়ার মানে দাঁড়ায় আইনগতভাবে অপরাধের মোকাবিলা করতে না পারা। কিন্তু বেআইনিভাবে একবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে। (শেষ)