'বন্দুকযুদ্ধের' সন্ত্রাস কোনো সমাধান নয়

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

আমরা কি দমনমূলক সমাজ চাই, নাকি ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ চাই? আমাদের আগে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার দায়িত্বের জন্য বাহিনীগুলো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অধিকার পেয়েছে। তারা আগ্নেয়াস্ত্রের দায়িত্বশীল ব্যবহার করছে কি না, সেটা দেখা প্রয়োজন। মোদ্দা কথা হলো, সন্ত্রাস দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

সংবিধানের ৩১ থেকে ৩৫ ধারায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আচরণ কী হবে, কোন আদালতে কোন অপরাধের বিচার হবে, কোন অপরাধের শাস্তি কী—তা পরিষ্কারভাবে বলা আছে। তার বাইরে কি আমরা যেতে পারি?

বলা হচ্ছে, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য অথবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। আমাদের অর্থাৎ জনগণের করের পয়সায় এই অস্ত্র–গোলাবারুদ কেনা হয়। তাত্ত্বিকভাবে আমাদের অনুমোদন নিয়ে এর ব্যবহার করতে হবে। অস্ত্র ব্যবহারের নির্দিষ্ট বিধিমালা আছে, কতখানি পালিত হচ্ছে জানি না।

আমি একমত যে আইনের রক্ষকদের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে অহরহ অন্যায়–অপরাধের অভিযোগ উঠছে। এই অভিযোগগুলোর কি তদন্ত হচ্ছে? গত বছর মাদকবিরোধী অভিযানের শুরুতেই টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হলেন। এ ঘটনার কোনো কিনারা হলো না। কাউকে জবাবদিহি করতে হলো না। সুষ্ঠু তদন্ত হলো না।

যাঁকে অপরাধ দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, নৈতিকতার প্রশ্নে তাঁকে ছাড় দিলে তিনি নিজের স্বার্থে সুযোগ কাজে লাগাবেন, এটাই স্বাভাবিক। আমি এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাটা বলতে চাই। লাশগুলো ভেসে না উঠলে তো জানাই যেত না, এতগুলো মানুষ এভাবে খুন হয়েছেন। আমাদের অজান্তে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই আমরা।

আমরা সেই ২০০৪ সাল থেকে বলে আসছি, সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস দমন হয় না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায় না। যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার এমন ‘শর্টকাট’ এবং নির্ভরযোগ্য পথ থাকত, তা হলে অপরাধের প্রাতিষ্ঠানিক বিচারের ধারণা গড়ে উঠত না। আইন–আদালত, বিচারালয়, ভুক্তভোগীর বিচার পাওয়া বা অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগের মতো বিষয়গুলোও গুরুত্ব পেত না।

অপরাধ দমনের জন্য আইন ও বিচারের যে ধারা আমরা গ্রহণ করেছি, তার সঙ্গে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ যায় না। এটা ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা যদি ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে নীতি ও আইনকানুনও সে রকম হতে হবে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে সেই নীতিমালা মেনে চলতে হবে।

একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমার উদ্বেগের জায়গা হলো, অস্ত্রের ব্যবহার নৈতিক ও বৈধভাবে হচ্ছে না। রাষ্ট্র কোনো একটা বিশেষ তাগিদে ক্ষমতার ব্যবহার করছে। আমরা সরকারকে ক্ষমতা দিয়েছি, তার অপব্যবহার হচ্ছে কি না, সে প্রশ্ন করতে হবে। কারণ স্পষ্ট কিংবা স্বচ্ছ তথ্য আমরা সব সময় পাচ্ছি না।