হাল ছাড়ছেন না স্বজনেরা

রেজাউল করিমের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে আছে মেয়ে সাবা। আর ছেলের মৃত্যুর দিনে বিমর্ষ মা-বাবা। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের সিটি গেটের কালীহাটের বাসায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
রেজাউল করিমের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে আছে মেয়ে সাবা। আর ছেলের মৃত্যুর দিনে বিমর্ষ মা-বাবা। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের সিটি গেটের কালীহাটের বাসায়। ছবি: সৌরভ দাশ

তিন বছর বয়সী সাবা ওয়ালিয়া করিম এখনো বাবাকে খুঁজে ফেরে। ‘বাবা বাজারে গেছে, বাবা মসজিদে গেছে’, এসব বলে সান্ত্বনা দেন পরিবারের সদস্যরা। চট্টগ্রামে চলন্ত বাস থেকে ফেলে ব্যবসায়ী রেজাউল করিম হত্যার এক বছর ছিল গতকাল মঙ্গলবার। এই এক বছরেও গ্রেপ্তার হয়নি মামলার প্রধান আসামি বাসের চালক। অভিযোগ গঠিত না হওয়ায় শুরু হয়নি বিচারও।

উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ দেওয়ায় থেমে আছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান (পায়েল) হত্যা মামলার বিচার। চট্টগ্রামের বাসিন্দা সাইদুরকে মুন্সিগঞ্জ এলাকায় বাস থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

ফুটপাত দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন বেকারি কর্মী আমান উল্লাহ। পেছন থেকে আসা একটি ট্রাক তাঁর ওপর উঠে যায়। টেনেহিঁচড়ে প্রায় ২০০ গজ পর্যন্ত নিয়ে যায়। চালক গ্রেপ্তার হলেও জামিনে রয়েছেন। 

আলোচিত এ তিনটি ঘটনা ঘটে গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে। এক বছর পার হলেও দুটি মামলার বিচার এখনো শুরু হয়নি। একটির বিচার থেমে আছে। তবু হাল ছাড়ছেন না স্বজনেরা। 

রেজাউল করিম
রেজাউল করিম

‘বাবা আস না’

২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের প্রবেশমুখ সিটি গেটের পাশে গ্ল্যাক্সো কার্যালয়ের সামনে রেজাউল করিমকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর থেকে বাসের সহকারী মানিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি আদালতে স্বীকার করে বলেন, চালক সাদেকুল আলমের সঙ্গে ঝগড়ার পর রেজাউলকে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়। 

এ মামলায় পুলিশ চালক সাদেকুলসহ তিনজনের নামে অভিযোগপত্র দেয়। আসামি সাদেকুল আলম এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। পলাতক আসামির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন না আসায় অভিযোগ গঠন করা যাচ্ছে না। তবে পুলিশ বলছে, আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

গতকাল দুপুরে নগরের সিটি গেটের কালীহাটের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, রেজাউলের ছবি হাতে নিয়ে বসে আছেন বাবা অলি উল্লাহ। আর ছোট্ট সাবা চিৎকার করে বলছে, ‘বাবা আস না। বাবা আস না।’ দাদা অলি উল্লাহ ও মা মনোয়ারা বেগমের চোখে পানি।

সাইদুর
সাইদুর

‘বিচার কি পাব’

গত বছরের ২১ জুলাই রাতে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুর। দুই দিন পর ২৩ জুলাই মুন্সিগঞ্জের ভাটেরচর সেতুর নিচের খাল থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে গজারিয়া থানা-পুলিশ। তদন্ত শেষে ওই বছরের ৩ অক্টোবর এই ঘটনায় করা মামলায় চালক জামাল হোসেনসহ তিনজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। গত বছরের ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জ আদালত থেকে মামলাটি বিচারের জন্য চট্টগ্রাম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আসে। নয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্য হয়। জুন মাসে আসামিরা স্থগিতাদেশ আনায় থেমে আছে বিচার।

গতকাল নগরের হালিশহরে সাইদুলের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাবা গোলাম মাওলা ও মা কোহিনুর বেগম দুজনই অসুস্থ। কোহিনুর বেগমের কণ্ঠে বিচার না পাওয়ার অনিশ্চয়তা, ‘বিচার কি পাব? আসামিরা অনেক শক্তিশালী। এরপরও আশায় আছি কখন বিচার শেষ হবে।’ কাতারপ্রবাসী ছিলেন গোলাম মাওলা। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে দেশে ফিরে আসেন, আর যাননি।

আমান উল্লাহ
আমান উল্লাহ

দিনমজুর বাবার প্রার্থনা

ফুটপাত দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন বেকারি কর্মী আমান উল্লাহ। পেছন থেকে আসা একটি ট্রাক তাঁকে ধাক্কা দেওয়ার উপক্রম করে। একপর্যায়ে আমানের ওপর ট্রাক তুলে দেন চালক। প্রত্যক্ষদর্শী মোটরসাইকেল আরোহীরা ধাওয়া দিয়ে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার থেকে চালক একরাম খানকে ধরে পুলিশে দেন। গত বছরের ২২ জুলাই রাত সাড়ে নয়টায় নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এলাকায় মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিলেও বিচার এখনো শুরু হয়নি। ছেলে হত্যার বিচার হবে—দিনমজুর বাবার এটাই প্রার্থনা।