'কেউ দিলে খাইতে পাই, না দিলে উপাস করতে অয়'
সাংবাদিকদের দেখলেই ছুটে এসে নিজের কথা বলতে চান পঞ্চাশোর্ধ্ব সাফিয়া বেগম। ১৬ আগস্ট রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর এলাকার বস্তিতে আগুন লাগে। বস্তিতে তাঁর ঘর ছিল। ৮ বছর আগে সুদে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঘরটি কিনেছিলেন তিনি। সেই টাকা শোধ করে সম্প্রতি আরও এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন ঘরটি ঠিকঠাক করতে। মেরামতের কাজ শেষও হয়েছিল, কিন্তু ভয়াবহ আগুন সব শেষ করে দিয়েছে। তাঁর এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকলেও আছে ঋণের বোঝা।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে সাফিয়াসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। সাফিয়া বললেন, ‘টাহা-পয়সা ভিক্ষা করলেও পাওয়া যাইব, আমি টাহা-পয়সা চাই না। আমি চাই মাথা গোঁজার ঠাঁই।’ তিনি আক্ষেপ করে বললেন, ‘এই দেশে রোহিঙ্গারাও আশ্রয় পায়, আর আমরা এই দেশের ভোটার হইয়াও থাহার জায়গা পাই না।’
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর দিন কাটে গল্পগুজব করে। রাতে আশ্রয় নিতে হয় ত্রিপলের নিচে। থাকার জায়গা ফিরে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে তাঁরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে কথা হয় নিরু বেগমের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমার সব পুইড়া গ্যাছে, কিছুই বাঁচাইতে পারি নাই। এহন রাস্তাতেই থাকতে হইতাছে। তিন বেলা খাবার জোটে না। কহনো দুই বেলা, কহনো এক বেলা খাইয়া দিন পার করতাছি।’
দিনমজুর মো. জাহাঙ্গীর জানালেন, আগুন নেভানোর পর তিনি দেখলেন তাঁর ঘর এবং ঘরের কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। অন্যদের মতো তিনিও মাথা গোঁজার ঠাঁই ছাড়া আর কিছুই চান না। জাহাঙ্গীর আরও জানালেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রথম পাঁচ দিন খাবার দেওয়ার পর খাবারের বিষয়টিও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
জাহাঙ্গীরের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখনই এক কিশোর এসে খবর দিল, বস্তিবাসীদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন কয়েকজন। থালা, বাটি ও পলিথিনের ব্যাগ হাতে সবাই ছুটলেন খাবার সংগ্রহ করতে। গিয়ে দেখা গেল একটি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের কয়েকজন লোক আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের মাঝে খিচুড়ি বিতরণ করছেন। খিচুড়ি নিতে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন সবাই।
লাইনে দাঁড়ানো হেনা বেগমের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘টাহা-পয়সার অভাবে আছি। রাস্তাতেই থাকতে হইতেছে। কেউ দিলে খাইতে পাই, না দিলে উপাস করতে অয়।’ বড়দের পাশাপাশি খাবারের জন্য বাটি হাতে দাঁড়িয়েছে ছোট্ট রাসেল, সুরাইয়া, ইতিসহ অনেক শিশু।
বস্তির পুড়ে যাওয়া অংশটি শ্মশানের মতো নীরব পড়ে আছে। বস্তির অনেক ঘর তোলা হয়েছিল ডোবার ওপর। পোড়া বাঁশ, কাঠ, কয়লা ও আবর্জনা ভাসছে কুচকুচে কালো পানিতে। ডোবার পাশে বসে ছিলেন ষাটোর্ধ্ব রওশন আরা। বললেন, ‘আগুন যখন লাগল তহন শুধু ছেলের বউ ও নাতিনকে নিয়ে ঘর থাইকা বাইর হয়া আসি। আগুন নিবার পর দ্যাখলাম কিছু নাই। আমি এহন শূন্য। আমরা এহন মানুষের ঘরে ঘরে থাহি।’
অনেকেই ভিড় করেছেন ক্ষতিগ্রস্তদের নামের তালিকায় নিজের নাম খুঁজতে। ‘চলন্তিকা-ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের জরুরি মানবিক সহায়তা প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে কারিতাস বাংলাদেশ ও সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনোমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ)। তারাই প্রাথমিক নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকায় যাঁদের নাম আছে তাঁরা এখন সহায়তার অপেক্ষায় আছেন।