ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে মাঠে প্রথমবার বিশেষজ্ঞরা

বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণাঞ্চলে আগে কখনো ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস নেই। এর কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত বিভাগে মোট ৩ হাজার ৮৪১ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্তের দিক থেকে বরিশাল অঞ্চল তৃতীয় অবস্থানে থাকায় স্বাস্থ্য বিভাগ বিশেষ নজরদারির আওতায় এনেছে এই অঞ্চলকে। আইইডিসিআরের ১৯ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল ২১ আগস্ট থেকে বরিশাল নগরে কাজ করছে।

দলটির সদস্যরা জানান, রোগতত্ত্ব ও কীটতত্ত্ব বিভাগের দুটি দলে ১৯ জন সদস্য ২২ আগস্ট থেকে বরিশালের সব কটি ওয়ার্ডে কাজ শুরু করেন। সদস্যরা রোগতত্ত্বের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ছয়টি দলে এবং কীটতত্ত্বের সদস্যরা পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে এই নগরে কাজ করছেন।
রোগতত্ত্বের দলগুলো নগরের ৩০টি ওয়ার্ডে খানা জরিপ, জনসংখ্যার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগী আছে কি না, তা যাচাই এবং চলতি বছর যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের রোগের ইতিহাস এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছে। তারা নগরের ৩০টি ওয়ার্ডের ৩০০ পরিবারের তথ্য-উপাত্ত ও নমুনা সংগ্রহ করে। এরপর তারা মঙ্গলবার ও বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের রক্তের নমুনা, আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস সংগ্রহ করে।

অন্যদিকে কীটতত্ত্বের পাঁচটি দল নগরের ১২টি ওয়ার্ড বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, হাসপাতালগুলো থেকে মশার লার্ভার নমুনা সংগ্রহ করে।

দলটির প্রধান আইইডিসিআরের গবেষক ও রোগতত্ত্ববিদ ওমর কাইউম গত মঙ্গলবার রাতে বলেন, বরিশাল অঞ্চলে এবার ব্যাপকভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে। এটার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, মূলত সেটা চিহ্নিত করার জন্য তাঁরা মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। এসব তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু জানা যাবে।

স্থানীয়ভাবে এডিস জীবাণুবাহী মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ, লার্ভা থেকে মশার প্রজাতি শনাক্ত করতে হলে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। তাই এ নিয়ে এখনই এটা বলা যাবে না।’
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, বরিশালে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে। এরপর তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিভাগের ছয় জেলায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে পিরোজপুর জেলায়। গতকাল পর্যন্ত এই জেলায় আক্রান্ত হয়েছে ৪৪৭ রোগী। এরপরে আছে পটুয়াখালী জেলা। এখানে আক্রান্ত হয়েছে ৪২২ জন। এরপর বরিশালে ৩৯৬, ভোলায় ৩৮২, বরগুনায় ৩২০ জন আর ঝালকাঠিতে সবচেয়ে কম, ৭৯ জন।

বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৭২০ জন। মঙ্গলবার রাতে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে অন্তত ১০ জন রোগীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়।
বরগুনার আমতলী উপজেলা সদরের স্কুলছাত্র ফেরদৌস (১৬) সোমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে এসেছে। ফেরদৌস বলল, সে জীবনে কোনো দিন ঢাকায় যায়নি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র প্রসেনজিৎ (২৪) থাকেন নগরের দক্ষিণ আলেকান্দা সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গলিতে। তিন দিন আগে তিনি অসুস্থ হয়েছেন। প্রসেনজিৎ বলেন, তিন বছর ধরে তিনি ঢাকায় যাননি।

নগরের বাংলাবাজার এলাকার ব্যবসায়ী রাসেল হাওলাদার (৩৫) সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রাসেল বলেন, তিনি দুই বছর ধরে ঢাকায় যাননি। তবে ৯ দিন আগে তিনি পটুয়াখালী গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে গত শনিবার জ্বর হয়।

বরিশাল সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, গত ডিসেম্বর থেকে বরিশাল নগরের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য ১৫০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়মিত কাজ করছিলেন। মধ্য জুলাই থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০ করা হয়। প্রতিদিন সকাল আটটার পর প্রতিটি ওয়ার্ডে হ্যান্ড স্প্রে দিয়ে মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এত সব উদ্যোগের পরেও বরিশালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কেন ঠেকানো যায়নি, এটা ভাবাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগকে।

করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের প্রধান রবিউল ইসলাম বলেন, নগরীকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে গত ডিসেম্বর থেকে তাঁদের নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। তবে ডেঙ্গু প্রবণতার পর এই কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। তাঁদের কাছে যে তথ্য রয়েছে, তাতে নগরের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী খুব কম।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য-উপাত্তের ডেটাবেইস তৈরি করেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। তাই আক্রান্তদের ইতিহাস জানা যাচ্ছে না। ফলে পুরো বিষয়টি শনাক্ত করা এখন দুঃসাধ্য।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল গতকাল বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছে। তবে আগে বরিশালে আক্রান্তদের সংখ্যা বেশি ছিল। এখন পিরোজপুর, পটুয়াখালীতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসতে আরও বেশ কিছুদিন লাগতে পারে। তবে দক্ষিণাঞ্চলে এবার প্রথম ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়। এটা অনুসন্ধানের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি দল মাঠে কাজ করছে।