দেয়ালচিত্রে 'গেস্টরুম অত্যাচারের প্রতীক' হাফিজুর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের দেয়ালে আঁকা হাফিজুর মোল্লার গ্রাফিতিতে গেস্টরুমে নির্যাতনের প্রতিবাদ।  ছবি: আবদুস সালাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের দেয়ালে আঁকা হাফিজুর মোল্লার গ্রাফিতিতে গেস্টরুমে নির্যাতনের প্রতিবাদ। ছবি: আবদুস সালাম

সাড়ে তিন বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লার (১৯) করুণ মৃত্যু দেখেছিল বাংলাদেশ। এত দিন পর ক্যাম্পাসের দেয়ালচিত্রে সেই হাফিজুর ফিরে এসেছেন ‘গেস্টরুম অত্যাচারের প্রতীক’ হিসেবে।

অটোরিকশাচালকের ছেলে হাফিজুরের বাসা ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য ছিল না। তাই ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ মাধ্যমে উঠেছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম (এস এম) হলের বারান্দায়। গভীর রাতেও তাঁকে যেতে হতো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। ২০১৬ সালে জানুয়ারি মাসের শেষ ভাগে শীতের রাতের ধকল সইতে পারেননি হাফিজুর। আক্রান্ত হন নিউমোনিয়া ও টাইফয়েডে। চলে যান গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পূর্ব শ্যামপুরে। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ হলে ভালো চিকিৎসার জন্য রওনা দেন ঢাকায়। ২ ফেব্রুয়ারি রাতে পথেই তিনি মারা যান। 

হাফিজুরের ছবিসংবলিত বেশ কয়েকটি দেয়ালচিত্র এখন দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। এর একটি উপাচার্যের বাসভবনের প্রধান ফটকসংলগ্ন দেয়ালে। সেখানে স্টেনসিল (লেখা বা আঁকার জন্য ছিদ্রময় পাত) ব্যবহার করে আঁকা ছবির দুই পাশে লাল হরফে লেখা ‘গেস্টরুম অত্যাচারের প্রতীক হাফিজুর মোল্লা’। পাশেই কালো কালিতে লেখা ‘বৈধ সিট আমার অধিকার’।

>

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার দেয়ালচিত্র আঁকা হলো ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে আসনসংকট ও নির্যাতন নিয়ে।

এ ছাড়া ডাকসু ভবনের দক্ষিণ পাশের দেয়াল, ক্যাফেটেরিয়ার দেয়াল ও প্রবেশমুখেও একই রকম দেয়ালচিত্র ও স্লোগানের দেখা মিলবে। আবার ক্যাফেটেরিয়ার সামনে একচিলতে জায়গার নামকরণ করা হয়েছে ‘হাফিজ চত্বর’ নামে।

এ ধরনের দেয়ালচিত্র ‘গ্রাফিতি’ নামে পরিচিত। সাধারণত কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার শিল্পিত মাধ্যম হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার দেখা যায়। 

হাফিজুরের সহপাঠী ও পরিবারের অভিযোগ ছিল, শীতে বারান্দায় থাকা ও রাতে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়ায় অসুস্থ হওয়ার পরও ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রাতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয় হাফিজুরকে। তাকে প্রায়ই অন্য কর্মীদের সঙ্গে হলের মাঠে ‘গেস্টরুম’ করতে হতো। এই ‘গেস্টরুম’ হচ্ছে ছাত্রলীগের একটি দলীয় রীতি। এতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রলীগের কনিষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠরা বসে আলাপ-আলোচনা করেন। এ সময় তাঁদের ছাত্রলীগ করতে বা হলে থাকতে হলে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মূলত এটি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার একটি প্রয়াস। বিভিন্ন সময় সাধারণ ছাত্রদের এ কর্মসূচিতে যোগ দিতে চাপ দেওয়ারও অভিযোগ আছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাফিজুরের এই গ্রাফিতিগুলো আঁকা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও বর্ষের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মঞ্চ ‘বৈধ সিট আমার অধিকার’–এর উদ্যোগে। 

এ বিষয়ে মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সজীব হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘হলের সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা নেওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। কিন্তু বাস্তবে আমরা সেটা দেখতে পাই না। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাই সর্বেসর্বা। তাঁদের মর্জি অনুসারেই সবকিছু নির্ধারিত হয়। আমাদের অবস্থান এই অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় যার বলি হয়েছেন হাফিজুর মোল্লা, আবু বকর কিংবা এহসান রফিকের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীরা।’ 

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হলের দেয়ালে আঁকা দুটি গ্রাফিতি ব্যক্তিপরিসর ছাড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সাড়া জাগিয়েছিল। এর একটি মূর্ত করে তুলেছিল সিংহাসন ফুটো করে বেরিয়ে আসা একটা পেনসিলের চোখা প্রান্ত। পাশে লেখা ছিল, ‘উফ!’ আরেকটি চিত্রে বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর রাখা ছিল রিমান্ড কক্ষের বাতি। পাশে মোটা হরফে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশ রিমান্ডে’। 

এ ছাড়া ওই দেয়াল দুটিতেই আঁকা হয়েছিল ‘সহমত ভাই’ ও ‘হেলমেট ভাই’ নামের দুটি আলাদা গ্রাফিতি। দর্শনার্থীরা ‘সহমত ভাই’কে সংযুক্ত করেছিলেন সমাজে বিদ্যমান তোষামোদির চর্চার সঙ্গে। আর ‘হেলমেট ভাই’ সম্পর্কে তাঁদের মূল্যায়ন ছিল, এরা তোষামোদির চর্চাকারীদের পক্ষে কাজ করা পীড়নকারীদের দল। 

তবে হাফিজুরের গ্রাফিতি কারা এঁকেছে, তা জানা গেলেও উল্লিখিত চারটি গ্রাফিতির আঁকিয়েরা ছিল অচেনা।