দুই ইউনিয়নে ভয়াবহ ভাঙন

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ার ঢল্লাপাড়া গ্রামে পদ্মায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।  ছবি: প্রথম আলো
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ার ঢল্লাপাড়া গ্রামে পদ্মায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নে পদ্মায় তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে দ্বিতীয় দফায় পদ্মায় পানি বাড়ার সঙ্গে ভাঙনের মাত্রা বেড়েছে। এই সময় দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের শতাধিক পরিবারের বসতভিটা বিলীন হয়েছে। 

পদ্মার ভাঙন অব্যাহত থাকায় তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজারসহ নয়টি গ্রামের তিন সহস্রাধিক পরিবার, দৌলতদিয়া লঞ্চ ও ফেরিঘাট হুমকির মুখে রয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে পাউবো বালুভর্তি বস্তা ফেলার কাজ শুরু করেছে। তবে পাউবোর ভাঙন ঠেকানোর এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। 

 সরেজমিন দেখা গেছে, দৌলতদিয়া ও দেবগ্রাম ইউনিয়নের ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে। দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ঢল্লাপাড়া গ্রামে গত বছর ভাঙনের পর অবশিষ্ট থাকা ৫০টি পরিবারের বসতভিটা এবার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এসব পরিবারের সদস্যরা অন্য গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। দৌলতদিয়ার ঢল্লাপাড়া গ্রামের একমাত্র চলাচলের ইটের রাস্তার মাথায় এবং দেবগ্রামের কাজী কেরামত আলী সড়কের মাথায় ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাজবাড়ী কার্যালয় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে।

ঢল্লাপাড়া ও দেবগ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ঢল্লাপাড়া গ্রামের অবশিষ্ট ৫০টি পরিবারের বসতভিটাসহ গ্রাম বিলীন। বর্তমানে আবুল ডাক্তারের পাড়ার প্রায় ৪০০, ব্যাপারীপাড়ার ৮০০, লালু মণ্ডল পাড়ার ৪০০, আফসার শেখের পাড়ার ২৫০ এবং জয়দার মণ্ডলপাড়ার ও নতুনপাড়ার প্রায় ৩০০ পরিবারের বসতভিটা ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ঝুঁকিতে রয়েছে কুশাহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও যদুমাতবরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দেবগ্রাম ইউনিয়নের পদ্মার তীরের জলিল মুন্সী পাড়ার প্রায় ৮০০, কাওয়ালজানি গ্রামের ৫০০ এবং নুরু মণ্ডলের বাজারসহ এলাকার আরও প্রায় ৫০০ পরিবার ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়নের বেথুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নদীভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। 

 ঢল্লাপাড়া গ্রামের মোসলেম মীর মালত (৬০) ভাঙন আতঙ্কে বাড়ির চারটি ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন। শূন্য বসতভিটায় পড়ে থাকা খড়িসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র গোছানোর কাজে ব্যস্ত। মোসলেম মীর বলেন, ‘স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার ভালোই চলছিল। মেয়ে ও ছেলের বিয়ে দিয়েছি। মাঠে প্রায় ১৫ বিঘা জমি ও ১ বিঘা জমির ওপর বাড়ি ছিল। এখন কিছুই নেই বললেই চলে। সব কৃষিজমি নদীতে বিলীন হয়েছে। বসতভিটা থেকে ঘর সরিয়ে নিয়েছি। এখন যেকোনো মুহূর্তে বসতভিটাও নদীতে চলে যাবে।’ 

সরেজমিনে দেখা যায়, ঢল্লাপাড়া রাস্তার মাথায় নদীভাঙন প্রতিরোধের কাজ চলছে। এখানে ২০ জন শ্রমিকের মধ্যে কেউ বালু ভরছেন, কেউ বস্তার মুখ সেলাই করছেন। বালুভর্তি বস্তা ফেলা কাজের তদারকি করছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও গোয়ালন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম মণ্ডল। তাঁর সঙ্গে আছেন পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী আরিফ সরকার। 

 আওয়ামী লীগের নেতা নুরুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, গত শুক্রবার থেকে পদ্মা নদীতে দ্বিতীয় দফা পানি বাড়ার সঙ্গে বাতাস থাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পরদিন শনিবার থেকে ভাঙনের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। জয়দার মণ্ডলেরপাড়া ও দেবগ্রামের কাওয়ালজানি গ্রামের আরও ৫০টির বেশি পরিবার বসতভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। আবুল ডাক্তারের পাড়া ও জয়দার মণ্ডলপাড়ায় ভাঙনের মাত্রা বেড়ে গেলে দৌলতদিয়া লঞ্চ ও ফেরিঘাটে স্রোত আঘাত আনবে। বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে লঞ্চ ও ফেরিঘাট। ভাঙন প্রতিরোধে স্থানীয় সাংসদ কাজী কেরামত আলীর হস্তক্ষেপে তাৎক্ষণিকভাবে পাউবো দৌলতদিয়া ও দেবগ্রামের জন্য ১২ হাজার ৮০০ বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু জিও ব্যাগের পরিমাণ অপ্রতুল। বালুভর্তি জিও ব্যাগের পরিমাণ আরও দ্বিগুণ করা দরকার।

 দেবগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতর আলী সরদার বলেন, ‘এক সপ্তাহের ভাঙনে মাঠের পর মাঠ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এক সপ্তাহে শতাধিক বিঘা কৃষিজমি বিলীন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ঘর ও মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে ছুটে গিয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি। পদ্মা-তীরবর্তী মানুষের একটাই চাওয়া, আমরা ত্রাণ চাই না, নদীশাসন চাই।’

 পাউবোর রাজবাড়ী কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফ সরকার বলেন, ভাঙন প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী
প্রতিরক্ষামূলক কাজের অংশ হিসেবে প্রায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে দৌলতদিয়ার ঢল্লাপাড়া রাস্তার মাথায় এবং দেবগ্রামের কাজী কেরামত আলী সড়কের মাথায় বালুভর্তি প্রায় ১২ হাজার ৮০০ বস্তা ফেলা হচ্ছে। এলাকাবাসী ওই স্থানে আরও বালুভর্তি জিও ব্যাগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।