সুন্দরবনে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার

সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সুন্দরবনের খাল ও নদীতে নজরদারির অভাবে কীটনাশক দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ হচ্ছে না। সুন্দরবন-সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, জেলে নামধারী সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা দাদনদাতা ও আড়তদারদের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছে। এর ফলে মৎস্যসম্পদ ও জলজ প্রাণী ধ্বংসের মুখে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, এসব কীটনাশক যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। দুষ্কৃতকারীরা সেখান থেকে শুধু বড় মাছগুলো সংগ্রহ করে। ছোট মাছগুলো তারা নেয় না। কিন্তুÍএই ছোট মাছগুলো ছিল বড় মাছের খাবার। ফলে ওই এলাকার খাদ্যচক্রেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। আবার এই কীটনাশকমিশ্রিত পানি ভাটার টানে যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, তখন সেই এলাকার মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, যেসব খালে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়, তার বিষক্রিয়া সংশ্লিষ্ট এলাকায় চার মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত থাকে। এর চেয়ে সর্বনাশা কাজ আর কিছুই হতে পারে না।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা—এই দুই রেঞ্জেই এক দশক ধরে এই সর্বনাশা কর্মকাণ্ড চলে আসছে। তবে চাঁদপাই রেঞ্জেই মৎস্যদস্যুদের অপতৎপরতা তুলনামূলক বেশি। এ রেঞ্জের জোংড়া, ঢাংমারী, বৈদ্যমারী, জয়মনী, কাটাখালী, জিউধরা, নন্দবালা, ঘাগরামারী, হারবাড়িয়া, শুয়ারমারা, হরিণটানা, নলবুনিয়া, আন্ধারমানিক, মরা পশুর, ঝাঁপসি, লাউডোব ও সংলগ্ন নলিয়ান রেঞ্জের কালাবগী, ঝনঝনিয়া, হলদিখালী, টেংরামারী, ভদ্রা, কোরামারীসহ বনের আশপাশ এলাকার বিভিন্ন খাল ও নদী এলাকায় এখন কীটনাশক প্রয়োগ করে মাছ ধরা হচ্ছে।

উপকূলীয় এলাকা ও বন বিভাগের লোকজন বলেন, দুর্বৃত্তরা বনে প্রবেশের সময় নৌকায় বিষাক্ত কীটনাশক নিয়ে যায়। পরে জোয়ার হওয়ার কিছু আগে কীটনাশক চিড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে নদী ও খালের পানির মধ্যে ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই এলাকায় থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কীটনাশকের তীব্রতায় নিস্তেজ হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। তারা ওই মাছ উঠিয়ে নেয়।

পরে এসব মাছ প্রথমে স্থানীয় আড়তে আনা হয়। পরে স্থানীয় বিভিন্ন বাজারসহ বিভিন্ন শহরে বাস-ট্রাক ও পিকআপযোগে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। অথচ মাছে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করার কোনো পরীক্ষাগার বন বিভাগের নেই। 

মোংলা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অনিমেষ বালা বলেন, মাছ ধরতে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, তা ধানসহ বিভিন্ন শাকসবজির খেতের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ মারার কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি খুবই বিষাক্ত। মোংলার কীটনাশক বিক্রেতা ও ডিলারদের নির্দেশনা দেওয়া আছে, যেন তাঁরা তালিকাভুক্ত চাষি ছাড়া অন্য কারও কাছে এসব বিক্রি না করেন।

উপকূলীয় এলাকার লোকজন বলেন, জেলে নামধারী মৎস্য দুর্বৃত্তরা স্থানীয় কিছু মৎস্য আড়তদার, দাদনদাতা ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতার লোকজন। তাঁরা মূলত জেলেদের মোটা অঙ্কের দাদন দিয়ে এ কাজ করতে বলেন। তাঁদের সঙ্গে আছে একশ্রেণির অসাধু কীটনাশক বিক্রেতা। চক্রের লোকজন ওই বিক্রেতাদের কাছ থেকে অবাধে কীটনাশক সংগ্রহ করে তা মাছ ধরার কাজে অপব্যবহার করছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও উৎকোচের বিনিময়ে এসব জেলেকে বনে মাছ ধরার অনুমতি দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এসব আড়তদার, দাদনদাতা ও স্থানীয় নেতার নামের তালিকা নেই বন বিভাগ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে। 

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, অধিক মুনাফা লাভের আশায় জেলে নামধারী এই দুর্বৃত্তরা জুলাই ও আগস্ট মাসে বেশি তৎপর থাকে। সে জন্য সুন্দরবনের সব খালে এই দুই মাস তাঁরা মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। নিয়মিত টহল রয়েছে। তারপরও কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরা থেমে নেই।

সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগ সূত্র জানায়, কীটনাশক প্রয়োগে মাছ শিকার নিয়ে ২০০৮-০৯ সালে আটটি মামলা হয়েছে। ২০ জনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। ২০১০-১১ সালে সাতটি মামলা ও ১৬ জনকে আটক করা হয়। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরার অপরাধে ১৮ জনের নামে মামলা হয়। তবে আটক করা হয় মাত্র আটজনকে। 

সর্বশেষ চলতি বছরের ২২ জুলাই পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সূর্যমুখী খাল থেকে দুজনকে দুই বোতল কীটনাশক ও কীটনাশক দিয়ে ধরা ৪ কেজি ৮০০ গ্রাম বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আটক করে বন বিভাগ। এর আগে গত ১৫ ও ১৬ জুলাই আটক হয় চারজনকে। 

মোংলা-রামপালের সাংসদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, দুষ্কৃতকারীদের বিষয়ে বন বিভাগসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে তিনি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি ব্যক্তিগতভাবে সভা-সমাবেশে কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে স্থানীয় মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন। কীটনাশক প্রয়োগে মাছ শিকার আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে বলে দাবি করেন তিনি।

বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য সুন্দরবনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরলে শুধু সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। এই বিষাক্ত পানি পান করে বাঘ, হরিণ, বানরসহ সব বন্য প্রাণীই মারাত্মক হুমকির মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় মানুষের পানীয় জলের উৎসগুলোও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। সুন্দরবনসংলগ্ন নদ-নদীগুলো ইলিশশূন্য হয়ে পড়ছে। কীটনাশক প্রয়োগে বনজ সম্পদ পাচার, বন্য প্রাণী নিধন, জলবায়ুজনিত পরিবর্তন, দস্যুবৃত্তির চেয়েও ভয়াবহ বিপর্যয়। সরকারের এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।