কৃষিযন্ত্রের কারিগর

তরুণ বয়সে নদীভাঙনে সব হারিয়েছেন। মাথা গুঁজতে গেলেন অন্য জেলায়। গায়ে-গতরে খেটে কোনোরকমে চলছিল। একসময় যন্ত্রপাতি মেরামতের একটি ওয়ার্কশপে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই কাজটা রপ্ত করে ফেলেন। বছর চারেকের মাথায় নিজেই একটি ওয়ার্কশপ খুলে বসেন। মাত্র ৪ হাজার টাকা পুঁজি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করা সেই ওয়ার্কশপ এখন দেশের অন্যতম কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে ২০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বিক্রি হয়।

সাফল্যের এই গল্প চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের উদ্যোক্তা মো. ওলি উল্লাহর। দেশি উপকরণ ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি যন্ত্রপাতি বানান। এসব যন্ত্রপাতির দাম কম। আবার চাষাবাদে খরচও কম। বিদেশি যন্ত্র দেখে দেখে ওলি উল্লাহ এখন পর্যন্ত ১৮ রকমের কৃষিযন্ত্র বানিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন কাজ করছেন ৩২ জন। তাঁকে দেখে আশপাশের জেলার অনেকে কৃষি যন্ত্রপাতি বানানোর দিকে ঝুঁকেছেন।

গোড়ার কথা
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ বাজারে ওলি উল্লাহর প্রতিষ্ঠান; নাম জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৯২ সাল থেকে কারখানার যাত্রা শুরু। এলাকায় তিনি ‘ওলি হুজুর’ নামে পরিচিত। আদি বাড়ি তাঁর কুমিল্লার দেবীদ্বারে। ১৯৮৮ সালে নদীভাঙনে বসতভিটাসহ সব হারিয়ে চলে আসেন চুয়াডাঙ্গায়। তখন তিনি ২৪ বছরের তরুণ। শুরুতে দিনমজুরের কাজ করতেন। কিছুদিন পর সরোজগঞ্জ বাজারের ইসলাম মেকানিকে কাজ শুরু করেন।
বছর চারেকের মধ্যে তিনি যন্ত্র বানানো ও মেরামতের কাজ রপ্ত করে ফেলেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেন, নিজেই একটি ওয়ার্কশপ দেবেন। কিন্তু পুঁজি তো নেই। চার বছরের কাজের অভিজ্ঞতা আর ৪ হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করলেন ওলি। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিলে তিলে গড়া জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং এখন দেশের কৃষিপ্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি খাতের অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। বীজ বপন যন্ত্র, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিন (ধান কাটা ও মাড়াইয়ের যন্ত্র), খড় ও ঘাস কাটার যন্ত্র, আলু লাগানো ও উত্তোলনের যন্ত্র, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারসহ ১৮ রকমের কৃষিযন্ত্র বানায় জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং। এর মধ্যে বাজারে ১৬টি যন্ত্রের চাহিদা বেশি। সারা দেশে তাদের আছে ৫০টি ডিলার।
বাজারের সাধারণ কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিনের দাম ১২ থেকে ২৮ লাখ টাকা। আর তাঁর তৈরি একটি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার মেশিনের দাম পড়ে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। জানালেন ওলি।

ধান কাটা ও মাড়াইয়ের যন্ত্র কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের পাশে ওলি উল্লাহ (বাঁয়ে)। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা সদরের শাহাপুরে।  প্রথম আলো
ধান কাটা ও মাড়াইয়ের যন্ত্র কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের পাশে ওলি উল্লাহ (বাঁয়ে)। সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা সদরের শাহাপুরে। প্রথম আলো

জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একদিন
ওলি উল্লাহ এখন জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দুটি কারখানা আছে তাঁর। তৃতীয় কারখানার কাজ শুরু হয়েছে। সেটি হবে স্বয়ংক্রিয়। ওলি জানান, নতুন কারখানায় উৎপাদন শুরু হলে কৃষিযন্ত্রের উৎপাদন খরচ কমবে এবং কৃষকেরা কম খরচে মানসম্মত যন্ত্র কিনতে পারবেন।
২০১০ সাল পর্যন্ত জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং কেবল প্যাডেল থ্রেশার বানাত। এটি দিয়ে ধান থেকে তুষ আলাদা করে চাল বের করা হয়। ওই বছর এই যন্ত্রটি বানাতে জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিরি) থেকে সহযোগিতা পায়। ওলি উল্লাহ ও তাঁর জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উদ্যোগকে শুরু থেকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড। সে সহযোগিতা এখনও অব্যাহত আছে। আর কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল মেইজ অ্যান্ড হুইট ইমপ্রুভমেন্ট সেন্টার (সিমিট) ও ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ।জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিরি ২০১৫ সালে যৌথভাবে দেশি প্রযুক্তিতে বানানো কৃষিযন্ত্র দিয়ে চাষাবাদ করেছে। তাতে খরচ হয় ৭ লাখ টাকা। অথচ বিদেশ থেকে আনা যন্ত্র দিয়ে একই চাষাবাদ করলে খরচ পড়ত ১৫ লাখ টাকা।

২০১৫ সালের মধ্যেই জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং খুলনা ও বরিশাল বিভাগে কৃষিযন্ত্র বিক্রির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। ২০১৬ সাল নাগাদ তাদের বাজার ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। দারিদ্র্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে সফল উদ্যোক্তা হওয়ায় চলতি বছরের ৩ মার্চ ওলিকে বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এসএমই ফাউন্ডেশন।

গত বুধবার সরোজগঞ্জ বাজারে জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, কাচের শোকেসে থরে থরে সাজানো শতাধিক ক্রেস্ট ও সম্মাননা স্মারক। এসবই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে ওলির পাওয়া নানা পুরস্কার। ওলি বলেন, ‘আমরা শুধু যন্ত্র বানাই না। এর পাশাপাশি যন্ত্র বানাতি ৪৫টি কর্মশালার মাধ্যমে ২২০ জনকে প্রশিক্ষণও দিয়েছি। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই, ইডা ঠিক। তবে আমরা কাজ করতি করতি মেলা কিছু শিখিছি।’

কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কথা
ওলির কাছ থেকে একটি সিডার মেশিন, ধান কাটার রিপার মেশিন ও ধান মাড়াইয়ের ড্রাম থ্রেশার মেশিন কিনেছেন কুতুবপুর ইউনিয়নের কৃষক মাহবুবুর রহমান। নিজের জমিতে কাজের পর তিনি এসব যন্ত্র অন্যের জমিতে ভাড়ায় খাটান। মাহবুবুরের কথায়, ‘আমি তাঁর কাছ থেকে তিনটা মেশিন কিনিছি ৯৫ হাজার টাকায়। অন্য কোম্পানির একই মেশিন কিনতে আমার ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা লাগত। ওলি হুজুর মানুষ ভালো। এ এলাকায় তাঁর খুব নামডাক। এসব যন্ত্রে কোনো সমস্যা হলে উনি নিজেই ঠিক করে দেন।’

সরোজগঞ্জ বাজারের মীম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক মিলন মিয়া বলেন, ‘ওলি হুজুরের কারখানায় কাজ করার সুমায় উনি নিজি হাতে আমার সবকিচু শিখিয়েলো। অ্যাকন আমি নিজিই এট্টা কারখানার মালিক।’

ওলির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা এবং পাশের ঝিনাইদহ ও মেহেরপুরের অন্তত ৮৬ জন উদ্যোক্তা কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও বিপণন করছেন। যাঁদের বেশির ভাগই একসময় ওলির কারখানার কর্মচারী ছিলেন।

কৃষিযন্ত্র বানাতে ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ নিজেই বানান ওলি। আর ৩০ শতাংশ যন্ত্রাংশ দেশের বাইরে থেকে আমদানি করেন। দেশে তৈরি শতভাগ যন্ত্রাংশ দিয়ে কৃষিযন্ত্র বানানোর স্বপ্ন দেখেন ওলি উল্লাহ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বলেন, ওলি উল্লাহ স্বল্পমূল্যে কৃষককে কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করছেন, তা কৃষিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।