৪২-এ পা দেওয়া বিএনপির সামনে 'চার লক্ষ্য'

বিএনপির বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি এখন আর চোখে পড়ে না। ফাইল ছবি
বিএনপির বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি এখন আর চোখে পড়ে না। ফাইল ছবি

প্রতিষ্ঠার পর বিএনপি এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। দলীয় প্রধান কারাগারে, আন্দোলনে সুবিধা করতে না পারা, নির্বাচনে ভরাডুবি, নতুন-পুরোনো জোটে অসন্তোষ, অঙ্গসংগঠনগুলোয় অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং দলের নেতাদের মতপার্থক্য প্রায়ই সামনে চলে আসছে। সব মিলিয়ে বিএনপি অনেকটাই কোণঠাসা। তবে নেতারা বরাবরই বলে আসছেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জোরদার করতে হবে। প্রতিষ্ঠার ৪২তম বছরে এসে দলটি চারটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগোতে চায়।

বিএনপির নেতারা জানান, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, সংগঠন গোছানো, ৪২ তম বছরেই কাউন্সিল করা এবং নির্বাচন আদায়সহ বৃহত্তর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যকেই দলটি এখন প্রাধান্য দিতে চাইছে।

তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, নতুন বছরে যে প্রত্যাশা নিয়ে তাঁরা এগোতে চান, তা কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে সংশয় আছে।

আগামীকাল ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বছর ধরে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে ছাড়াই বিএনপিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে হচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কোনো উপায় নেই জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতা জমিরউদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখন খুব কেয়ারফুলি এগোতে হবে। রাজনীতি করতে গিয়ে দলকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে না। কিছু করতে গেলেই ধরে নিয়ে যাবে, মামলা দেবে। যতক্ষণ না কোনো সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে আন্দোলনের ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু করা সম্ভব না।’

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বেই মূলত ছোট ছোট কর্মসূচি চোখে পড়ে। ফাইল ছবি
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বেই মূলত ছোট ছোট কর্মসূচি চোখে পড়ে। ফাইল ছবি

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতারা সব ধরনের সভা সমাবেশেই দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কথা বলেন। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া ১৮ মাস ধরে কারাগারে আছেন। বিএনপি অভিযোগ করে আসছে, সরকার মিথ্যা মামলায় তাঁকে আটকে রেখেছে। তবে তাঁর মুক্তির জন্য বিএনপি সভা, সমাবেশ বা অনশনের বাইরে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।

স্থানীয় পর্যায়ে দলের নতুন করে কার্যকরী কমিটি করা এবং তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্বকে শক্তিশালী করে দল গোছাতে শুরু করেছে বিএনপি। এ ছাড়া অঙ্গসংগঠনগুলোতেও নতুন করে কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের কাউন্সিল। সেখানে ২৭ বছর পর বিএনপির এই অঙ্গসংগঠন নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব পেতে যাচ্ছে। ঈদুল আজহার আগ দিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা কয়েকটি বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করেছিল। বাকি শহরগুলোতেও করার কথা রয়েছে।

বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিল হয় ২০১৬ সালের মার্চে। তিনবছর পর পর তাদের কাউন্সিল হওয়ার কথা। সে হিসেবে এ বছরের মার্চে কাউন্সিলের সময় ছিল। দলীয় প্রধানকে কারাগারে রেখে কাউন্সিল করবে কিনা তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে সংশয় ছিল। তবে দলটি এখন কাউন্সিল করার ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থানে এসেছে। দলীয় সংগঠনগুলো গুছিয়ে এনে ৪২তম বছরেই তারা কাউন্সিল করার কথা ভাবছে। দলের এক সূত্র জানায়, এ বছরের ডিসেম্বরে দলীয় কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের আনাগোনা খুব একটা চোখে পড়ে না। ফাইল ছবি
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের আনাগোনা খুব একটা চোখে পড়ে না। ফাইল ছবি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল মাত্র ছয়টি আসন পায়। সরকার ‘ভোট ডাকাতি’ করছে বলে নিজেদের ভরাডুবি হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদে দলটি অংশ নেয়নি। এবার নির্বাচনের আগ দিয়ে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে আহ্বায়ক করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে জোট গঠন করে বিএনপি। নাগরিক ঐক্য, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নিয়ে গঠিত এ জোট বেশ আলোচিত ছিল। একই ব্যানারে নির্বাচনও করে তারা। তবে নির্বাচনের পরপরই জোটের নেতাদের অসন্তোষ প্রকাশ্য হতে থাকে। গত পাঁচ মাস ধরে জোটটি নিষ্ক্রিয়। এর মধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ জোট ছেড়ে দিয়েছে। বিএনপির আরেক পুরোনো জোট ২০ দলেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। সে জোটের সঙ্গী বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থও জোট ছেড়ে দিয়েছেন। এ জোটেরও কার্যক্রম নেই।

বেশ কয়েক মাস থেকেই বিএনপি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার কথা বলছে। দলের এক সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দলসহ সরকার বিরোধী অন্যান্য দলগুলোকে নিয়ে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে চায়। দৃশ্যমান কোনো বৈঠক বা সভা না হলেও নিজেদের মধ্যে নেতারা এ ব্যাপারে আলোচনা করছেন। পুনরায় নির্বাচন আদায়ের দাবিতে বিএনপি আরেকটি ‘বড়’ জোট গড়তে চায়।

কোনো অবস্থাতেই সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন করতে না পারা নিয়ে নেতাকর্মীসহ শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও হতাশা আছে। রাজনীতির বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গত বছরে বড় কয়েকটি আন্দোলন হয়েছিল। সেসব ইস্যুতেও বিএনপি এগোতে পারেনি। দলটি বলছে, মামলা-হামলায় তারা জর্জরিত। দলের নেতারা ‘বড়’ একটি আন্দোলন প্রয়োজন বলে মনে করছেন। তবে তারা সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চায়। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি প্রথম আলোকে জানান, গত ১৩ বছরে দলে ওপর দিয়ে ঝড় গিয়েছে। তবে তারা ঐক্যবদ্ধ আছেন। পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তিনি।

দলের আরেক স্থায়ী কমিটির নেতা গয়েশ্বরচন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর, অনেকটা অনুপস্থিত। গণতন্ত্র উদ্ধার আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্য এখনো আমাদের মধ্যে জাগ্রত। সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার সংগ্রামেই আছি আমরা।’

বিএনপি দুরবস্থা বা কঠিন সময় পার করছে কিনা প্রসঙ্গে গয়েশ্বর বলেন, বিএনপি যতটুকু কঠিন সময় পার করছে তার চেয়ে বেশি কঠিন সময় পার করছে জনগণ। জনগণের অবস্থা ভালো থাকলে বিএনপির অবস্থা খারাপ থাকার কথা না বলে জানান। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চক্রান্তের একটি অংশ হিসেবে হচ্ছে খালেদা জিয়া কারাগারে। গণতন্ত্রের মুক্তি আর খালেদা জিয়ার মুক্তি এক ও অভিন্ন।