আশ্রয়ণ প্রকল্পে নানা অনিয়ম

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় পাওয়া ঘরের সামনে বিধবা রিজিয়া বেগম। গত শনিবার তোলা।  প্রথম আলো
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় পাওয়া ঘরের সামনে বিধবা রিজিয়া বেগম। গত শনিবার তোলা। প্রথম আলো

যশোরের অভয়নগর উপজেলার চলিশিয়া ইউনিয়নের গ্রামের বিধবা রিজিয়া বেগম। সরকারের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় তিনি একটি ঘর পেয়েছেন। ঘরটি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ টাকা। সম্প্রতি তাঁর ঘরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু ঘরটি নির্মাণের জন্য তাঁর নিজের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩ হাজার টাকা।

রিজিয়া বলেন, ‘শেখ হাসিনা আমারে ঘর দিয়েছেন। সব খরচ তাঁর। তারপরও ঘরে বালু ও মাটি ভরাট, মিস্ত্রিদের খাওয়ার খরচ এবং বকশিশ বাবদ আমার মোট ৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ঘরে দেওয়া কাঠ ভালো না। মেঝেতে ইট বসিয়ে সিমেন্ট-বালু দিয়ে ডলে দিয়েছে। ঘরে দুটি জানালা দিয়েছে। জানালায় কোনো রড নেই।’

রিজিয়ার মতো উপজেলার অন্য উপকারভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, ঘর নির্মাণে তাঁদের বিভিন্ন উপকরণ দিতে হচ্ছে। বালু ও মাটি দিয়ে ঘরের মেঝে ভরাট করে দিতে হচ্ছে। খেতে দিতে হচ্ছে নির্মাণশ্রমিকদের। আর নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের সামগ্রী।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প সূত্র জানায়, উপজেলায় আটটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পরিচালিত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ‘যার জমি আছে ঘর নেই, তার নিজ জমিতে গৃহনির্মাণ’ উপখাতের আওতায় উপকারভোগীদের ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলায় মোট ১৮৬ জন উপকারভোগীকে এ ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে নওয়াপাড়া পৌরসভায় ২৩ জন, প্রেমবাগ ইউনিয়নে ২১ জন, সুন্দলী ইউনিয়নে ১৮ জন, চলিশিয়া ইউনিয়নে ৮ জন, পায়রা ইউনিয়নে ২১ জন, শ্রীধরপুর ইউনিয়নে ১৭ জন, বাঘুটিয়া ইউনিয়নে ১৩ জন, শুভরাড়া ইউনিয়নে ২০ জন এবং সিদ্দিপাশা ইউনিয়নে ৪৫ জন ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। ইতিমধ্যে ঘরের প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ টাকা। উপজেলায় মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, কাজটি বাস্তবায়নে পাঁচ সদস্যের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমিটির আহ্বায়ক, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্যসচিব এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কমিটির সদস্য। ইউএনওর তত্ত্বাবধানে পিআইসি দ্বারা উপজেলা প্রশাসন সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ঘর নির্মাণকাজ সম্পাদন করবে। নির্মাণকাজের সঙ্গে অবশ্যই শ্রমিক হিসেবে উপকারভোগী পরিবারকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করে বলেন, কোনো আলোচনা ছাড়াই ইউএনও মো. শাহীনুজ্জামান নিজেই নির্মাণশ্রমিকদের দিয়ে ঘর নির্মাণের সব কাজ করাচ্ছেন। এ কাজে তিনি সহযোগিতা নিচ্ছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রিজিবুল ইসলামের।

সরেজমিনে গেলে কয়েকজন উপকারভোগী অভিযোগ করে বলেন, ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘরের মেঝে এবং বারান্দা মাটি ও বালু দিয়ে ভরাট করার কথা। কিন্তু উপকারভোগীদের দিয়ে মাটি ও বালু ভরাট করা হচ্ছে। কোনো কোনো ঘরে খোয়া ছাড়াই মেঝে করা হচ্ছে। মেঝেতে ৩ ইঞ্চি ঢালাই দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ১ ইঞ্চি বা তার কম। মেঝেতে ঢালাইয়ের নিচে পলিথিন এবং খোয়া দেওয়া হচ্ছে উপকারভোগীর কাছ থেকে নিয়ে। চারটি জানালার বদলে দেওয়া হচ্ছে দু-তিনটি করে জানালা। দরজায় রং করার নিয়ম থাকলেও তা করা হচ্ছে না। ঘরের বেড়া, ঘর ও চালে কাঠ ব্যবহারের তালিকায় রয়েছে শাল, গর্জন, জারুল, কড়ই, শিলকড়ই, শিশু, তাল, পীতরাজ, দেবদারু ও আকাশমণি। কিন্তু দেওয়া হচ্ছে সারি-অসারি মেহগনি কাঠ। ল্যাট্রিনে আটটি রিং স্লাব দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ছয়-সাতটি করে। ঘর নির্মাণশ্রমিকদের চার-পাঁচ দিন দুই বেলা করে খেতে দিতে হচ্ছে। নির্মাণকাজের শ্রমিক হিসেবে উপকারভোগী পরিবারকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না।

পায়রা ইউনিয়নের কাদিরপাড়া গ্রামের মোমেনা বেগম একটি ঘর পেয়েছেন। মেঝে ছাড়া তাঁর ঘরের নির্মাণকাজ শেষও হয়েছে। মোমেনা বলেন, ‘ঘর করতে আমি ১০০ ইট দিয়েছি। এ ছাড়া ইট ভেঙে খোয়া বানাতে এবং ঘরে ও বারান্দায় বালু ভরাট করতে আমার সাড়ে ৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এরপরও ঘরের কাজ ভালো হয়নি। দুটি জানালা দিয়েছে, তাতে রড দেওয়া হয়নি। কাঠ এবড়োখেবড়ো। ল্যাট্রিনে রিং স্লাব বসানো হয়নি।’

একই গ্রামের অস্থায়ী পাটকলশ্রমিক আমিন উদ্দিন শেখ বলেন, ‘ঘরের মেঝে ও বারান্দা মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে বলেছে। আমি লোকজন নিয়ে তা দিয়েছি। এখন বলছে বালু দিয়ে ভরাট করে দিতে। বালু ভরাট না করলে মিস্ত্রি কাজ করবে না। বালু ভরাট করতে ২-৩ হাজার টাকা লাগবে। টাকার অভাবে বালু ভরাট করতে পারছি না। প্রায় এক মাস ধরে ঘর সেভাবে পড়ে আছে।’

অভয়নগর গ্রামের বিধবা ফজিলাতুন্নেছা বেগম বলেন, ‘আমাকে ১০০ ইট দিতে হয়েছে। ঘরের মেঝে ও বারান্দা বালু দিয়ে ভরাট এবং মিস্ত্রিদের খাওয়া বাবদ আমার প্রায় ৮ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। তারপরও ঘরের মেঝে মাত্র ১ ইঞ্চির মতো ঢালাই দিয়েছে। ঘরে তিনটি জানালা দিয়েছে।’

বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ গোলাম হোসেন বলেন, ‘ঘর নির্মাণে ইউএনও আমাকে কিছুই জানাননি। মাঝে একদিন উনি আমাকে ডেকে বললেন, ঘরের তালিকায় আপনার স্বাক্ষর লাগবে। সেভাবে আমি স্বাক্ষর করেছি। এর চেয়ে বেশি আর কিছুই জানি না।’ প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মফিজ উদ্দীন বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের ব্যাপারে ইউএনও সাহেব কোনো দিন মিটিং করেননি। কমিটিতে আছি, সেটাই জানতাম না। পরে শুনেছি। কয়েক দিন আগে একটি কাজে ইউএনও অফিসে গিয়েছিলাম। ইউএনও সাহেব বললেন, প্রেমবাগ ইউনিয়নে ২১ জনের তালিকা হয়েছে। তালিকায় স্বাক্ষর করেন। তাই করেছি।’

শ্রীধরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘শুনেছি, ঘর নির্মাণ কমিটির সদস্য আছি। তবে কী কাজ, কিসের কাজ, কিছুই জানি না।’

ইউএনও মো. শাহীনুজ্জামান বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ যথাযথভাবে করা হচ্ছে। নির্মাণসামগ্রীর মানও ভালো। কমিটির অন্য সদস্যদেরও কাজ দেখাশোনার দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা যে অভিযোগ করছেন, তা সঠিক নয়। তাঁরা কাগজপত্রে স্বাক্ষর করছেন।’