খুলনায় নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

খুলনায় হঠাৎ​ নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। গত আট মাসে কেবল ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৭টি শিশু। হঠাৎ করে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি এবং শিশুরা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন এখানকার নাগরিক সমাজ। তাদের মতে, অনলাইনে অশ্লীল ভিডিও একশ্রেণির মানুষের মধ্যে বিকৃত চিন্তার প্রসার ঘটাচ্ছে, যা এ ধরনের অপরাধে তাদের উদ্বুদ্ধ করছে। 

এ ছাড়া সামাজিক অবক্ষয়, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং কখনো কখনো আইনের ফাঁক গলে বা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার কারণে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়াটাও এ অপরাধে সহায়ক ভূমিকা রাখে বলে মত এসেছে। 

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, জাতীয় নির্বাচনের পর চলতি বছরের জানুয়ারি​ থেকে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে খুলনায়। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) ২৫টি ঘটনা ঘটে। পরের তিন মাসে ঘটে ২৮টি ধর্ষণের ঘটনা। এই ছয় মাসে ৩৪টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর গত দুই মাস জুলাই ও আগস্টে আরও ১৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়। যার মধ্যে শিশু রয়েছে ১৩টি।

এ–সংক্রান্ত প্রাপ্ত হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খুলনায় ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ২০১৭ সালে এমন ঘটনা ছিল ৪৩টি। তার পরের বছর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২টিতে। আর চলতি বছরে প্রথম আট মাসের ঘটনা আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। 

এ ধরনের ভুক্তভোগীদের চিকিৎ​সা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। এ সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. অঞ্জন রায়ের মতে, অনলাইনে অশ্লীল ভিডিও বা​ পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা ধর্ষণ বাড়ার একটা বড় কারণ। 

পুলিশের সূত্র জানায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খুলনা মহানগর ও জেলার থানাগুলোতে ধর্ষণ মামলা হয় ৬টি। এরপর এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ১৪টি। আর আগস্টে ধর্ষণের মামলা হয় ৬টি। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ধর্ষণের শিকার অনেকে লোকলজ্জা ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঘটনা চেপে যান। অনেকে আবার আপস করেন বা করতে বাধ্য হন। ফলে থানায় ধর্ষণের মামলার সংখ্যা কম। 

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, খুলনায় হঠাৎ করে ধর্ষণের সংখ্যাধিক্য দেখা যাচ্ছে। শিশুরা বেশি শিকার হচ্ছে। পুলিশ ধর্ষণের ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। ধর্ষণের শিকার নারী–শিশুদের পাশে ভালোভাবে থাকছে। সম্প্রতি পুলিশ ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রচার ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। 

>এমন অপরাধ বৃদ্ধিতে অনলাইনে অশ্লীল ভিডিও, সামাজিক অবক্ষয়, বিচারের দীর্ঘসূত্রতাকে বড় কারণ মনে করছে নাগরিক সমাজ।

পুলিশ কমিশনার বলেন, আগে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত এবং ভুক্তভোগীরা এক বয়সসীমার মানুষ ছিল। এখন সব বয়সী নারী–শিশু শিকার হচ্ছে। অপরাধীরাও বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি–পেশার রয়েছে।

ধর্ষণের পাশাপাশি খুলনা অঞ্চলে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও বাড়ছে। খুলনা মহানগরী ও জেলার থানাগুলোতে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৫৪টি এবং পরের তিন মাসে ৭৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে। 

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী মমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এত বিপুলসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা আগে ছিল না। সামাজিক অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অনলাইনের অশ্লীল ভিডিও ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি।

এ ধরনের ঘটনায় পুলিশ সদস্য জড়িত হওয়ার অভিযোগও আছে। গত ২ আগস্ট রাতে খুলনা রেলওয়ে থানায় (জিআরপি) এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ছাড়া শিশু, গৃহবধূ, ​বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মাঝবয়সী ব্যক্তি, বখাটে তরুণ বা সহপাঠীর দ্বারা। 

ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ। গত ৯ জুলাই ও ২৮ আগস্ট নগরীর শিববাড়ি মোড়ে খুলনার ৪২টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধন করে। 

সামাজিক সংগঠন ‘নারী উদ্যোগের’ নারী সেলের আহ্বায়ক আইনজীবী শামীমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, খুলনায় ধর্ষণের ঘটনা, বিশেষত শিশু ধর্ষণ এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। দ্রুত বিচার না হওয়ায় অনেকে এই অপরাধে উৎসাহী হচ্ছে। তিনি মনে করেন, ধর্ষণ প্রতিরোধে দ্রুত বিচার ও রায় কার্যকর করা, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রতি বাড়তি নজর রাখা এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।