মৃত সাঈদ যেভাবে জীবিত হয়ে ফিরে এল

কাগজ-কলমে নিহত সাঈদ গত ২৯ আগস্ট জীবিত অবস্থায় বাবা-মায়ের মাঝখানে বসে আছে । ছবি: আসাদুজ্জামান
কাগজ-কলমে নিহত সাঈদ গত ২৯ আগস্ট জীবিত অবস্থায় বাবা-মায়ের মাঝখানে বসে আছে । ছবি: আসাদুজ্জামান

‘রাত আটটায় লঞ্চ ছাড়ে। আবু সাঈদ রাত সাড়ে ১২টায় ঘুম থেকে জেগে ওঠে। বলে, প্রস্রাব করতে যাবে। সাইফুল আর আমি তাকে নিয়ে আসি নিচতলায়। এরপর ওকে লঞ্চের পেছনে নিয়ে যাই। এমতাবস্থায় আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। আর দেখি নাই।’

খুনের এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আফজাল হোসেন। একই কথা আদালতে বলেন সাইফুল ইসলাম।

কিশোর আবু সাঈদ হত্যায় দায়ে আফজাল, আফজালের বোন সোনিয়া, সাইফুল আর শাহীনের বিচার চলছে ঢাকার আদালতে। তদন্ত কর্মকর্তাসহ সব সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণও শেষ। এমনকি কথিত আবু সাঈদ হত্যা মামলায় এর আগে দুই দফা রায়ের তারিখ ঠিক হয়। আদালত বদলের কারণে রায়ের পর্যায় থেকে যুক্তিতর্ক শুনানিও হয়। হত্যা মামলার শুনানির তারিখ রয়েছে ৫ সেপ্টেম্বর। এমতাবস্থায় আসামিপক্ষ থেকে সাঈদের বাবার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করা হয়।

অথচ কাগজ-কলমে নিহত সেই কিশোর আবু সাঈদ ফিরে আসে গত বৃহস্পতিবার। আর তাকে পাওয়া গেল বিহঙ্গ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন খোকনের বাসায়।

কীভাবে নিহত আবু সাঈদ তাঁর বাসায় এল, তা জানালেন নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, আফজাল, সোনিয়াদের বাড়ি তাঁর এলাকায়। আবু সাঈদ খুনের মামলার আসামি হওয়ার পর তাঁদের পরিবার দেখা করে। আবু সাঈদ নামের এক কিশোর হত্যার দায়ে তাঁরা অভিযুক্ত। অথচ আবু সাঈদকে তাঁরা চেনেনই না; খুন তো অনেক পরের কথা। এরপর সাঈদের বাবা আজমের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

বিহঙ্গ পরিবহনের মালিক নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরা (সাঈদের বাবা) খলিল নামের একটা লোকের মাধ্যমে আসামিপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেয়। ওরা চেয়েছিলেন আট লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত আমি বলেছি চার লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত সাঈদের বাবা আজম পাঁচ লাখ নেন। এই টাকা নিয়ে আজম উধাও হয়ে যায়।’

নাসির উদ্দিনের তথ্য অনুযায়ী, খুনের মামলায় আপস করার জন্য সাঈদের বাবা এই পাঁচ লাখ টাকা নেন দুই বছর আগে।

নাসির উদ্দিন বলেন, তিনি নিজে সাঈদের বাবা আজমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আজমকে তাঁর পল্লবীর বাসায় দেখা করতে বলেন। আজম আসার পর তিনি জানান, সাঈদ হত্যা মামলার পরবর্তী শুনানি ৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন যেন তিনি আদালতে যান। ওই তারিখে তিনি (আজম) যেন আদালতে গিয়ে কিছু একটা কথা বলেন।

বিহঙ্গ পরিবহনের মালিক নাসির উদ্দিন খোকন। ছবি: আসাদুজ্জামান
বিহঙ্গ পরিবহনের মালিক নাসির উদ্দিন খোকন। ছবি: আসাদুজ্জামান

বিহঙ্গ পরিবহনের মালিক বলেন, ‘আমি আজমকে বলি, তুমি যদি আদালতে গিয়ে কিছু একটু বলো, তাহলে ওদের (আফজাল) সাজা একটু কম হবে। এর বিনিময়ে আমি তোমাকে সম্মান করব, অর্থকড়ি দেব। দোকান করতে পারবা। আগে তো তুমি আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছ। ৫ তারিখে একটু আসো।’

নাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে আজম চলে যান। এরপর আজম একদিন নিজেই নাসির উদ্দিনকে ফোন করেন।

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আজম নিজ থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বলে, স্যার, একটা ভালো খবর আছে।’
‘কী খবর।’
‘আমার ছেলে পাওয়া গেছে।’

‘তখন আমি বললাম, ভাগ্যে তোমার ছেলে আছে। আল্লাহ তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছে। আমি তাঁকে বলি, আমি তোমার ছেলেটাকে দেখতে চাই। কীভাবে কী হয়েছিল আমি তোমার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’


‘ওকে লোভ দেখাই। তাঁকে একটা ছোট পান দোকান করে দেওয়া হবে। লোভের আশায় আজম আমার বাসায় আসে।’

বিহঙ্গ পরিবহনের মালিক বলেন, ‘আজমদের আসার কথা ছিল বিকেল পাঁচটায় (২৯ আগস্ট)। কিন্তু সেই সময় আসে না। আসে এর পরে। আজম আসার পর বসার ব্যবস্থা করি। এসি ছেড়ে দিলাম। চা দিতে বললাম। সাঈদকে দেখার পর একটু আদর-যত্ন করলাম। তখন আমি ফোন দিলাম পল্লবী থানার ওসিকে।’

কথিত সাঈদ হত্যার আসামি আফজাল। ছবি: আসাদুজ্জামান
কথিত সাঈদ হত্যার আসামি আফজাল। ছবি: আসাদুজ্জামান

কিশোর সাঈদের কাছে নাসির উদ্দিন প্রথমে জানতে চান, এত দিন সে কোথায় ছিল।

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, বাবা (সাঈদ), তুমি এত দিন কোথায় ছিলা।’
সাঈদ বলল, ‘স্যার, আমি তো হারাইনি। আমি তো বাবার সঙ্গে রাগ করে চলে গিয়েছিলাম। হাজারীবাগ থেকে প্রথমে নবীনগর, এরপর সেখান থেকে গাজীপুরের শ্রীপুর যাই। আমি গাড়িতে কাজ করছি। বাবা তো জানে, আমি কোথায় ছিলাম।’

নাসির উদ্দিন জানান, সাঈদের মুখে এমন কথার পর তাঁর মা–বাবা আর কোনো কথা বলেননি। চুপচাপ ছিলেন।

নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আজম দাবি করেন, সাঈদকে ১০ থেকে ১৫ দিন আগে পাওয়া গেছে। আমি বললাম, পুলিশকে কেন তুমি জানালে না। আজম বলল, ‘স্যার, আমি তো এসব বিষয় কিছু বুঝি না। তখন আমি বলি, তোমার ছেলেকে থানায় হ্যান্ডওভার না করলে তো তুমি বিপদে পড়ে যাবা।’

নাসির উদ্দিনের ফোনে পুলিশ বাসায় আসে। সেখান থেকে আবু সাঈদসহ তাঁর মা–বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পল্লবী থানার পুলিশ। পরদিন ৩০ আগস্ট সোনিয়া বাদী হয়ে সাঈদসহ সাতজনের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় সাঈদসহ চারজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার এসআই লন্ডন চৌধুরী বলেন, সাঈদ দাবি করছে, কয়েক দিন আগে সে তার মা–বাবার কাছে ফিরেছে। সাঈদের মা–বাবা একেক সময় একেক কথা বলছেন।

কিশোর আবু সাঈদ হত্যা মামলায় তাঁর মা–বাবা দুজনই ঢাকার আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছেন।

ভুল করেননি, দাবি এসআইয়ের
আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আফজালসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন ডিবির তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন। বর্তমানে তিনি ডেমরা থানায় কর্মরত।

আবু সাঈদ ফিরে আসার পর এসআই রুহুল আমিন দাবি করছেন, তদন্তে কোনো ভুল তিনি করেননি। সঠিকভাবে তদন্ত করে যা পেয়েছিলেন, তা–ই তিনি আদালতকে জানিয়েছেন। আফজাল আর সাইফুল স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে সাঈদ হত্যায় অভিযোগপত্র দেন।

সাঈদ হত্যা মামলার তদন্তে কোনো ভুল হয়নি বলে জানান এসআই রুহুল আমিন।

কথিত সাঈদ হত্যার আসামি সোনিয়া। ছবি: আসাদুজ্জামান
কথিত সাঈদ হত্যার আসামি সোনিয়া। ছবি: আসাদুজ্জামান

রুহুল আমিনের কাছে প্রশ্ন ছিল, এই মামলায় কীভাবে খুনের দায়ে অভিযোগপত্র দিলেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘ওরা (সাইফুল ও আফজাল) স্বীকার করেছে, ওরা লঞ্চ থেকে ফেলে মেরে ফেলেছে। ওদের ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে চার্জশিট দিয়েছি। এর বাইরে কোনো কাহিনি নেই।’

আবু সাঈদ যে খুন হয়নি, তা জানানোর পর রুহুল আমিন বলেন, ‘কিশোর সাঈদ বেঁচে গেছে। দরকার হলে মামলা পুনরুজ্জীবিত করুক।’

রুহুল আমিনের কাছে জানতে চাইলাম, এ রকম ভুল কীভাবে হলো? রুহুল আমিন বলেন, ‘ভুল ইনভেস্টিগেশনের কিছু নেই। নিবিড়ভাবে ইনভেস্টিগেশন করেছি। সব থানায় চিঠি দিয়েছি। চিঠির জবাব এসেছে। ওরা স্বীকার করছে, খুন করছে। তখন আমি চার্জশিট না দিয়ে পারি? দরকার হলে এখন পুনঃ তদন্ত করার জন্য পারমিশন করাক। অসুবিধা কোথায়।’

যে লঞ্চ থেকে আবু সাঈদকে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ, সেই লঞ্চের কারও জবানবন্দি নেওয়া হয়নি, তা আদালতকে জানান এসআই রুহুল আমিন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘লঞ্চ তো বিভিন্ন জায়গায় ঘোরে, আসে–যায়। তারা নিজেরাই তো স্বীকার করেছে অভিযান নামের লঞ্চ থেকে সাঈদকে ফেলে দিয়েছিল।’

মিথ্যা খুনের অভিযোগে আফজালরা জেল খাটলেন—এ ব্যাপারে রুহুল আমিন বলেন, ‘এ জন্যে তো ওদের (কিশোর সাঈদ, তার বাবা) বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে। রিমান্ডে এসেছে। আমার বিষয়ে যদি আমার ডিপার্টমেন্ট কিংবা বিজ্ঞ আদালত কৈফিয়াত তলব করেন, তাহলে আমার জবাব দেব। আমি ডিপার্টমেন্টে খারাপ অফিসার না, অনেক ভালো অফিসার।’