পুলিশের ওপর পাঁচ হামলার চারটিই দূরনিয়ন্ত্রিত বোমায়

সবশেষ গত শনিবার রাতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা হয়। ফাইল ছবি
সবশেষ গত শনিবার রাতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা হয়। ফাইল ছবি

পুলিশের ওপর সাম্প্রতিক পাঁচটি বোমা হামলার চারটিই ছিল দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা। সর্বশেষ গত শনিবার রাতের হামলায়ও একই ধরনের বোমা ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনা একই কায়দায় এবং কাছাকাছি সময়ে ঘটেছে। ব্যবহৃত বিস্ফোরকও একই ধরনের। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, হামলার লক্ষ্যবস্তু, সময় ও স্থান নির্ধারণ এবং সর্বোপরি হামলার ধরন দেখে তাঁরা মনে করছেন, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ কোনো দল ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এসব হামলাকে বড় কোনো ঘটনার পূর্বাভাস বলে মনে করছেন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একাধিক সূত্র বলছে, গুলশানে হোলি আর্টিজানে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের কারণে আইএস মতাদর্শ অনুসর​ণকারী জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবি অনেকটাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের অনেকেই নিহত হয় কিংবা গ্রেপ্তার হয়। তবে তিন বছরের মাথায় এসে এই গোষ্ঠী আবার নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। ​গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় আইএসের (ইসলামিক স্টেট) ভয়ংকর হামলার পর এখানকার এই জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন করে অনুপ্রাণিত হয়। এর সাত দিনের মাথায় ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ​হামলা হয়। হোলি আর্টিজান এবং তার আগের হামলাগুলোর মতো পুলিশের ওপর এই হামলারও দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। আইএসের দাবি নাকচ করে দিলেও এই হামলায় যে জঙ্গিগোষ্ঠী যুক্ত, তা অবশ্য নাকচ করেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা​কারী বাহিনী।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, নব্য জেএমবির কোনো একটি ছোট দল বা সেল এই হামলায় যুক্ত বলে তারা ধারণা করছে। তবে তারা কারা, তা শনাক্ত করতে না পারায় এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে একের পর ঘটনায় উদ্বেগ ও অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর তদন্তের অগ্রগতি এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে গতকাল সোমবার বিকেলে পুলিশ সদর দপ্তরে এক জরুরি সভা হয়। এতে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (গোয়েন্দা) মো. হায়দার আলী খান ঘটনা সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করেন। সভায় জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় পুলিশের চলমান তৎ​পরতা অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী এবং পুলিশ, সিটিটিসি, এটিইউ, এসবি, সিআইডি, পিবিআই ও র‍্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

>পুলিশের ওপর সাম্প্রতিক সময়ে ৫টি বোমা হামলা
প্রতিটি ঘটনা একই কায়দায়, কাছাকাছি সময়ে
পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলার ঘটনায় উদ্বেগ
জঙ্গিরা আবার মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে

নতুন করে সক্রিয়: লক্ষ্যবস্তু পু​লিশ

গত এপ্রিলে আইএসপন্থীদের টেলিগ্রাফ অ্যাপে ‘লোন উলফ’ হামলা (সংঘবদ্ধভাবে না করে একক পরিকল্পনায় হামলা) এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করতে এখানকার জঙ্গিদের প্রতি আহ্বান জানানোর খবর বের হয়। এরপর গত জুনের মধ্যভাগে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআইয়ে (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) ‘লোন উলফ’ হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়ে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছিল বলে জানা গেছে। এরপর গত মাসের প্রথম সপ্তাহে জঙ্গি আক্রমণের হুমকিসংবলিত একটি ভিডিও বার্তার কথা প্রকাশ পায়।

রাজধানী ঢাকায় পুলিশের ওপর ধারাবাহিক এই হামলার শুরু গত ২৯ এপ্রিল। আর সর্বশেষ ঘটনা ঘটে শনিবার রাতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে। এ সময়ে পাঁচটি ঘটনার মধ্যে তিনটিতে বিস্ফোরণে পুলিশের পাঁচজন সদস্য, একজন কমিউনিটি পুলিশ সদস্য, একজন রিকশাচালক ও একজন নারী আহত হন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাত সোয়া নয়টার মধ্যে গুলিস্তান, মালিবাগ ও সায়েন্স ল্যাবরেটরির জনবহুল মোড়ে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আর রাজধানীর ব্যস্ততম মোড় পল্টন ও খামারবাড়ি এলাকার দুটি পুলিশ বক্সের পাশ থেকে দুটি বোমা উদ্ধার করা হয়। সেটাও রাতের ঘটনা। তবে কখন বোমা দুটি পেতে রাখা হয়েছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। উদ্ধার করা হয়েছে রাত ১০টার পর।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া রোববার এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, গুলিস্তান ও মালিবাগের ঘটনায় ব্যবহৃত বোমাগুলো দূরনিয়ন্ত্রিত ছিল।

ডিএমপির কাউন্টার টেররিজমের ইউনিটের (সিটিটিসি) একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পল্টন ও খামারবাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া বোমাগুলোতেও তাঁরা দূরনিয়ন্ত্রণের আলামত জব্দ করেন। সর্বশেষ শনিবার রাতে হামলায় ব্যবহৃত বোমাটিও দূরনিয়ন্ত্রিত কি না, সেটি তাঁরা খতিয়ে দেখেছেন।

সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয় দলের উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন রোববার প্রথম আলোকে বলেন, এই পাঁচটি ঘটনায় নিম্নমানের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে। বোমাগুলো দেখে মনে হয়েছে, যারা এসব আইইডি (বোমা) তৈরি করেছে, তারা ততটা দক্ষ নয়। খুব শক্তিশালী বিস্ফোরণ বা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মতো সক্ষমতা তাদের হয়নি। ছানোয়ার হোসেন বলেন, ইতিপূর্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব জঙ্গি হামলা হয়েছে, সেগুলোর চেয়ে এই পাঁচটি ঘটনা একেবারেই আলাদা। কিন্তু এই পাঁচটি ঘটনা একই রকম। তাঁর মতে, এই হামলাগুলো যারা করছে, তারা ‘খুব দুর্বল, বিচ্ছিন্ন ও ছোট’।

তবে শনিবার রাতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা বড় কোনো হামলার ‘টেস্ট কেস’ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি রোববার সাংবাদিকদের বলেন, এটি পুলিশের ওপর হামলা। তবে এ ধরনের ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে একসময় যে মন্ত্রী-সাংসদেরা টার্গেট হবেন না, তা বলা যায় না। জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে, কিন্তু নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে—এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ ব্যাপারে সতর্কতা আছে, প্রস্তুতি আছে এবং এই চক্রকে বের করার জন্য অনুসন্ধান চলছে।

পুলিশের ওপর হামলার প্রথম চারটি ঘটনার তদন্ত করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সাধারণত জঙ্গি–সংশ্লিষ্টতা আছে বা থাকতে পারে—এমন ঘটনাগুলোই তদন্ত করে থাকে এই ইউনিট। শনিবারে সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ের ঘটনাটিও সিটিটিসিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেখান থেকে কিছু পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের ওপর ধারাবাহিক অভিযানে তাঁরা ভেবেছিলেন, জঙ্গিদের যে সদস্যরা আইইডি (হাতে তৈরি বোমা) বানাতে সক্ষম, তারা সবাই হয় নিহত হয়েছে; না হয় কারাগারে রয়েছে। কিন্তু দূরনিয়ন্ত্রিত এই বোমাগুলোর বিস্ফোরণ তাঁদের আবারও ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। কম শক্তিশালী এই বোমাগুলোর বিস্ফোরণ তাদের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। 

কারা জড়িত

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। এসব ঘটনায় হওয়া মামলার এজাহারেও একই কথা বলা হয়েছে। এই ঘটনাগুলোতে জঙ্গিরা জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। তবে শনিবার রাতের হামলার পর জঙ্গিরা জড়িত—এমন কথা আর বলতে চাইছেন না কর্মকর্তারা। 

গতকাল সিটিটিসির প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, নব্য জেএমবির নামে জামায়াত-শিবিরের লোকজনই পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, জেএমবি ছিল মূলত জামায়াত-শিবিরের সাবেক নেতা-কর্মীদের তৈরি একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন। এ রকম কিছু লোককে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার যখন শুরু হয়, তখন তারা যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, সেটার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা দেখেছে পুলিশকে। তারা নৈরাজ্য যাতে তৈরি হতে না পারে, তা প্রতিহত করেছে পুলিশ। পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে, জানমালের ও সরকারি সম্পত্তির নিরাপত্তার স্বার্থে আইন প্রয়োগ করেছে। এটি তাদের বিপক্ষে গেছে। ফলে সেদিক থেকে পুলিশের প্রতি তাদের একটি ক্ষোভ রয়েছে।’

অবশ্য গত ৯ আগস্ট নব্য জেএমবির উলফ প্যাকের পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের খবর জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ওই পাঁচজনের মধ্যে শিবলী শাহাজাদ ইস্তিহাদি আইইডি তৈরির কিছু সরঞ্জাম জোগাড় করেছিলেন। সম্প্রতি খামারবাড়ি ও পল্টন এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া আইইডিতে গ্যাসের একধরনের ক্যান ব্যবহৃত হয়েছিল। সে ধরনের চারটি কনটেইনার শিবলী শাহাজাদ সংগ্রহ করেছিলেন। ওই ঘটনার সঙ্গেও এই পাঁচজনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।

এসব ঘটনায় কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী জড়িত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হতেও পারে। বিষয়টা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছি। আমরা কখনো বলি নাই যে জঙ্গিদের মূলোৎ​পাটন করতে পেরেছি। এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আ​ছি।’

উদ্বেগ

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। তবে এ ঘটনার কয়েক বছর আগে থেকে বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো ঘটনা ঘটিয়েছিল সংগঠনটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখন ঘটনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজানে হামলার আগেও জঙ্গিরা বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হত্যা (টার্গেট কিলিং) করেছিল। 

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের ওপর হামলা দেখে মনে হচ্ছে, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এটা বিশেষভাবে উদ্বেগের। তাঁর মতে, জঙ্গিদের যে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, সেটা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদের উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।