ছোট উদ্যোগে বড় পরিবর্তন

রাজধানীর নবাবপুরের দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের উদ্যোগে মশকনিধন অভিযান। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ওই এলাকায় প্রতিদিন আটটি ফগার মেশিনে মশকনিধনসহ প্রচারপত্র বিলি করেন তাঁরা। গতকাল দুপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর নবাবপুরের দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের উদ্যোগে মশকনিধন অভিযান। ডেঙ্গু প্রতিরোধে ওই এলাকায় প্রতিদিন আটটি ফগার মেশিনে মশকনিধনসহ প্রচারপত্র বিলি করেন তাঁরা। গতকাল দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৫ আগস্ট তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আশিকুর রহমান হাসপাতালে মারা যায়। এর দুই দিনের মাথায় আড়াই বছরের জেরিয়ানারও একই কারণে মৃত্যু হয়। এই দুই শিশুর বাসা আজিমপুরে পাশাপাশি।

আশিকুর থাকত আজিমপুর রোডের ১৫৪/১ নম্বর বাসায়। এর পাশের ১৫৫/১ নম্বর বাসায় থাকত জেরিয়ানা। দুই শিশুর মৃত্যুর পর সেখানকার বাসিন্দারা এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননক্ষেত্র নিজ উদ্যোগে পরিষ্কার করার উদ্যোগ দেন। নিজেরাই ভবনের চারপাশ ও ছাদ পরিষ্কার করেন।

শিশু দুটির প্রতিবেশী তসলিম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুটি মৃত্যুর ঘটনার পর সিটি করপোরেশনের ওপর আমরা আর ভরসা রাখতে পারিনি। মশা নিয়ন্ত্রণে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে সাততলা ভবনের চারপাশ ও ছাদ পরিষ্কার করি।’

আজিমপুর এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাভুক্ত। আজিমপুর এলাকার বাসিন্দাদের মতোই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসির) পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৩৩৪/২ নম্বর বাসার ব্যবস্থাপক আমির হোসেনও একই উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি নিজের বাড়িসহ পাশের নালাও পরিষ্কার করেন। এমনকি পাশের নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে আছে কি না, তা-ও নিয়মিত দেখভাল করেন।

>মশা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা নগরবাসীর
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক ও সামাজিক উদ্যোগ বেড়েছে

এ বছরের এপ্রিল থেকে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে। জুন-জুলাইয়ে রোগটি ঢাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতালে বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। এরই মধ্যে সিটি করপোরেশনের মশা মারার অকার্যকর ওষুধের বিষয়টি গণমাধ্যমেও উঠে আসে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এই পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারা মশা নিয়ন্ত্রণে নিজেরা উদ্যোগী হন।

আদালতের আদেশ ও গণমাধ্যমে সমালোচনার মুখে দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি শুরু করে। ডিএসসিসি গত ২১ জুলাই থেকে বাসাবাড়ি পরিদর্শনের কার্যক্রম চালাচ্ছে। কোনো স্থানে লার্ভা পেলে ওষুধ ছিটিয়ে তা ধ্বংস করছে। প্রথম দিকে পরিদর্শনকৃত বাড়ি বা ভবনের ৫ শতাংশের বেশি স্থানে লার্ভা পাওয়া যেত। সে হার এখন কমে ১ শতাংশের নিচে এসেছে। গত ২১ জুলাই থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন ভবন ও বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ডিএসসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইরফান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের সচেতনতা অনেক বেড়েছে। বাসাবাড়িতে না গেলে এটা বোঝা যাবে না। নিজের বাসার পাশাপাশি আশপাশও পরিষ্কার করছেন অনেকে। বাসাবাড়িতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করাও সচেতনতার আরেকটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।

একই চিত্র দেখা গেছে ডিএনসিসিতেও। ডেঙ্গু প্রতিরোধে দুভাবে অভিযান পরিচালনা করছে ডিএনসিসি। গত ২৪ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাসাবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অথচ ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে শুরু হওয়া চিরুনি অভিযানে লার্ভা পাওয়ার হার ৩ শতাংশের কম। ২৪ জুলাই থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে ৫৮ লাখ ১ হাজার টাকা।

এখন অভিযানে আগের তুলনায় লার্ভা কম পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিসচেতনতার পাশাপাশি মামলা ও দণ্ডের ভয়েও অনেকে পরিষ্কার করছেন। দ্বিতীয়বার পরিদর্শনেও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে হয়তো মানুষ আগের চেয়ে সচেতন হচ্ছে। এমনকি অভিযান চালাতে গিয়ে আগের মতো বাধা আসে না।

মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর বাসিন্দাদের নেওয়া পদক্ষেপ বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সচেতন মানুষ জ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেমন হাসপাতালে রোগ শনাক্ত করার জন্য গেছে, তেমনি এডিস মশা যেন বাড়িতে না থাকে, মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার উদ্যোগ নিয়েছে। পানি জমতে পারে, এমন সম্ভাব্য মশার প্রজননক্ষেত্র মানুষ ধ্বংস করেছে। ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, বাতিল পাত্র-বালতি-কৌটা মানুষ ফেলে দিয়েছে। প্রচুর পরিমাণ মশারি, মশার ওষুধ, মশার কয়েল, ফগার মেশিন মানুষ কিনেছে। মানুষকে সচেতন করার বা মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার ছোট ছোট উদ্যোগ পাড়া-মহল্লায় দেখা গেছে।

বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে এসেছে। মানুষ সচেতন হয়েছে, নিজেকে রক্ষার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার তথা সিটি করপোরেশনেরও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা আছে।

মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে আজিমপুরের বাসিন্দা আক্তার হোসেন, মতিউর রহমান, মো. রনি মশা মারার যন্ত্র কিনেছেন। এক মাস ধরে তাঁরা এসব যন্ত্র দিয়ে বাড়ির আঙিনায় নিয়মিত ওষুধ ছিটাচ্ছেন। মিরপুরের পল্লবী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বনানী, গুলশান এলাকায় অনেকে মশা মারার ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র কিনেছেন। খিলগাঁও, সেগুনবাগিচা, শান্তিনগর, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ এলাকার অন্তত ১১ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুই সপ্তাহ ধরে নিজ উদ্যোগেই তাঁরা বাসাবাড়ি পরিষ্কার করছেন। মাস দুয়েক আগেও তাঁরা পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে এতটা সচেতন ছিলেন না।

ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনও ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাচ্ছে। গত ৩১ জুলাই থেকে প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুরা ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করছেন। এর মধ্যে গতকাল সোমবার দেশের ৬৪ জেলায় একযোগে ১১৭টি বন্ধুসভার উদ্যোগে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করার পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়।

ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কে স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয় সম্প্রতি। এই কাজের জন্য ‘পরিচ্ছন্নতা ডট ২৮’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও খোলা হয়েছে। গ্রুপে সড়কের কোন জায়গায় কোন সমস্যা আছে বা সে সমস্যা কীভাবে মেটানো যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ২৮ নম্বর সড়কে ২২টির মতো বাড়ি রয়েছে। সেখানকার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। গত ৯ আগস্ট ২৮ নম্বর সড়কে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নেন তিনি।

গতকাল বিকেলে রাজধানীর নবাবপুর এলাকায় বিভিন্ন মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির উদ্যোগে আটটি ফগার মেশিন দিয়ে মশার ওষুধ ছিটানো হয়। এ ছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে লিফলেট বিতরণ করে তারা।

মশা নিয়ন্ত্রণে মানুষের নেওয়া ছোট ছোট উদ্যোগ বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুধু মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নয়, ঢাকা শহরকে সারা বছর পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রেও এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা দরকার। যেকোনো কাজে নাগরিকদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেই পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের।