সিলেটের কিনব্রিজ আর ঘড়ি দেখে মুগ্ধ মার্কিন রাষ্ট্রদূত

সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ ও আলী আমজাদের ঘড়িঘর এলাকা পরিদর্শনে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। ছবিটি মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজ ও আলী আমজাদের ঘড়িঘর এলাকা পরিদর্শনে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। ছবিটি মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেটের সুরমা নদীতে স্থাপিত ব্রিটিশ ঐতিহ্যের নিদর্শন কিনব্রিজকে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ পায়ে হাঁটার ব্রিজ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। তিনি ঐতিহ্যবাহী সেতুটি সংস্কার করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করায় সিলেট সিটি করপোরেশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি ব্রিজটির রক্ষণাবেক্ষণে মার্কিন সরকারের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

সিলেট সফরকালে আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় কিনব্রিজ পরিদর্শন করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। এ সময় সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায়, প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী শামছুল হক পাটোয়ারিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

কিনব্রিজ সিলেটের সুরমা নদীতে স্থাপিত প্রথম সেতু। ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৩ সালে লোহার কাঠামোয় দৃষ্টিনন্দন সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আসাম প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কিনের নামে এই সেতুর নামকরণ হয় কিনব্রিজ।

প্রায় আট দশক ধরে সচল সেতুটি মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সংস্কারকাজ শেষে সচল হয় সেতুটি। নব্বই দশকের পর সিলেটে সুরমা নদীর ওপর আরও চারটি সেতু নির্মাণ করা হয়। কিনব্রিজ নগরের মধ্যভাগে হওয়ায় যানবাহন চলাচল কখনো বন্ধ হয়নি। লোহা দিয়ে তৈরি কিনব্রিজের আকৃতি অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকানো। এর দৈর্ঘ্য ১,১৫০ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট।

দেশে ও বিদেশে সিলেটের প্রতীকখ্যাত কিনব্রিজ দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সংস্কারের জন্য ১ সেপ্টেম্বর থেকে কিনব্রিজ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রেখেছে সিটি করপোরেশন। সংস্কার শেষে কিনব্রিজটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত না করে শুধু পায়ে হেঁটে চলার প্রস্তাব করেছে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল দপ্তর। এ নিয়ে গতকাল সোমবার প্রথম আলোয় ‘কিনব্রিজ হবে দেশের দীর্ঘতম পদচারী-সেতু?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।

সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ দপ্তর জানায়, আজ বেলা সাড়ে ১১টায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার কিনব্রিজ পরিদর্শনে যান। পরিদর্শনকালে পায়ে হাঁটার বিষয়টি তাঁকে অবহিত করেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। রাষ্ট্রদূত তখন সেতুর উত্তর পাড়ে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সেতুর দক্ষিণ পাড় পর্যন্ত ঘুরে দেখেন। সেতু পার হওয়ার সময় রাষ্ট্রদূতকে মেয়র বলেন, কিনব্রিজটি এই অঞ্চলের প্রথম সেতু। এটি বর্তমানে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি সংরক্ষণ করার চিন্তাভাবনা থেকে ভবিষ্যতে শুধু পায়ে হেঁটে চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

কিনব্রিজের কাঠামো দেখে সংরক্ষণের এই চিন্তাভাবনাকে স্বাগত জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘মেরামত কাজ চলছে শুনে দেখতে এসেছি। কিনব্রিজ দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া ও এর সৌন্দর্য বাড়ানোর ব্যাপারে মেয়র প্রশংসনীয় কাজ করছেন। কিনব্রিজ অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে লম্বা পায়ে হাঁটার ব্রিজ।’ দৃষ্টিনন্দন কিনব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণে তাঁর সরকারের সহায়তা থাকবে বলে জানান রাষ্ট্রদূত।

কিনব্রিজের উত্তরপাড়ে আছে আরেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আলী আমজদের ঘড়িঘর। এটিও সিলেটের আরেকটি প্রতীক হিসেবে পরিচিত। কিনব্রিজ হয়ে নগরের প্রবেশমুখ সুরমা নদীর চাঁদনি ঘাট এলাকায় এটি অবস্থিত। ১৮৭৪ সালে কুলাউড়ার পৃথিম পাশার জমিদার নবাব আলী আহমদ খানের উদ্যোগে ঘড়িটি স্থাপন করা হয়। আড়াই ফুট ডায়ামিটারের ঘড়িটির কাঁটা দুই ফুট লম্বা। লোহার খুঁটির ওপর ঢেউটিন দিয়ে আবৃত সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির ঘড়িটি সিলেটের ঐতিহ্য। নবাব আলী আহমদ ঘড়িটি স্থাপন করলেও এটি পরিচিতি পায় তাঁর ছেলে আলী আমজাদের নামে।

কিনব্রিজ পরিদর্শন করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আলী আমজদের ঘড়িঘর দেখতে যান। এ সময় আলী আমজদের ঘড়িঘর স্থাপনের প্রেক্ষাপট তাঁকে জানানো হলে তিনি তখনকার সময়ে ঘড়ির ভূমিকাকে আরেক সচেতনতা বলে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রদূতকে তখন ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে শোনানো হয়। এ সময় তিনি বলেন, ‘কিনব্রিজের সঙ্গে আলী আমজদের ঘড়ি সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি শুনে মুগ্ধ হয়েছি।’

মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ঐতিহ্যবাহী এই সেতু টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শুধু পায়ে হাঁটার জন্য উন্মুক্ত রাখতে চাই। এটি করতে পারলে আমাদের এই কিনব্রিজ বিশ্বের একটি অনন্য স্থাপনা হবে, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যে তাই বোঝা গেল।’

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে

কিনব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়িঘর পরিদর্শনকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র। ভবিষ্যতেও থাকবে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এ লক্ষ্যে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারকে তাদের দেশে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ হন এবং সেখানে গিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারেন সে ব্যবস্থা মিয়ানমারকে করতে হবে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর বিশ্ব সম্প্রদায়ের বহুমুখী চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে দায়িত্ব পালন করে আসছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত গতকাল সোমবার সিলেট সফরে আসেন। হজরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহ পরিদর্শন করে তিনি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ‘আমেরিকা কর্নার’ পরিদর্শন করেন।