লক্কড়ঝক্কড় মাইক্রোবাসে যাত্রী বহন, ভাড়াও বেশি

কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস ফটক থেকে কোটবাড়ীর নন্দনপুর। ৬ কিলোমিটারের এই পথে মাইক্রোবাসে জনপ্রতি ভাড়া গুনতে হয় ২০ টাকা। নিরানন্দের এই ভ্রমণে আবার লক্কড়ঝক্কড় মাইক্রোবাসে ঠাসাঠাসি করে ১০ জন বসানো হয়। এর মধ্যে চালকের পাশে এক আসনেই বসানো হয় দুজন যাত্রীকে। বড় আকারের মাইক্রোবাসে আরও বেশি যাত্রী গাদাগাদি করে নেওয়া হয়। 

শুধু ওই পথে নয়; কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ১০৪ কিলোমিটার এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন শত শত মাইক্রোবাস। জেলার দাউদকান্দি উপজেলার মেঘনা–গোমতী সেতুর টোল প্লাজা থেকে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মোহাম্মদ আলী এলাকায় প্রতিনিয়ত যাত্রীবাহী এমন লক্কড়ঝক্কড় মাইক্রোবাসের দেখা মিলছে।

এলাকাবাসী ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মহাসড়কের এই অংশে তিন চাকার বাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের দাপট বেড়েছে। এই বাহন এখন লোকাল বাসের মতো মহাসড়কে যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী ওঠা–নামা করায়। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই যাতায়াতের কারণে মহাসড়কে প্রাণহানিও ঘটছে।

জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মহাসড়কে তিন চাকার বাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর হঠাৎ করেই মাইক্রোবাস নামানো হয়। এগুলোর বেশির ভাগেরই ফিটনেস ছিল না। আমরা অভিযান চালিয়ে কিছু মাইক্রোবাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমে আসছে।’ অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভাড়া নিয়ে আমরা কোনো হার নির্ধারণ করে দিইনি। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে এসব বাহনে করে মানুষ গন্তব্যে যাচ্ছে।’

সড়ক ও জনপথ (সওজ) এবং হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২২ জুলাই রাজধানী ঢাকায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সভাকক্ষে সড়ক তদারক কমিটির এক পর্যালোচনা সভা হয়। ওই সভা থেকে দেশের সব মহাসড়কে থ্রি-হুইলার (তিন চাকার বাহন) চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এরপর দেশের ২২টি মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ তিন চাকার সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে কুমিল্লা জেলা অংশের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে সড়কে অল্প দূরত্বে চলাচলকারী যাত্রীরা কিছুটা বিপাকে পড়েন। এ অবস্থায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস চলাচল শুরু করে। দিনে দিনে এ সড়কে এমন মাইক্রোবাসের সংখ্যা বাড়ছেই। অপর দিকে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আজও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। 

ময়নামতি-নন্দনপুর অংশে মাইক্রোবাস চালান কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বলরামপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আরিফ। অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০ টাকা ভাড়া নিচ্ছি। কারণ বিভিন্ন স্থানে আমাদের চাঁদা দিতে হয়।’

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার নিমসার, ময়নামতি সেনানিবাস ফটক, আলেখারচর, নন্দনপুর, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড ঘুরে দেখা গেছে, মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে চালকেরা মাইক্রোবাস সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করে রেখেছেন। বেশির ভাগ মাইক্রোবাসই ফিটনেসবিহীন। কোনোটার দরজা ঠিক নেই। কোনোটার জানালা ভাঙা। মাইক্রোবাসের ভেতরে তিনজনের আসনে চারজন বসানো হচ্ছে। কোনো ধরনের সংকেত ছাড়াই মহাসড়কে থেমে যাচ্ছে মাইক্রোবাস। যেখানে–সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলে আবার গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে। 

মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মাইক্রোবাস চলাচল করায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। সম্প্রতি চান্দিনা মহিলা কলেজের এক ছাত্রী একটি মাইক্রোবাসে করে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন। মাইক্রোবাসটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দেবীদ্বারের বরকামতা এলাকায় এসে থামে। সেখানে মহাসড়কের ওপর মাইক্রোবাস থামানোর পর পেছন দিক থেকে একটি গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়। এতে ওই ছাত্রী মারা যান।

মহাসড়কে তিন চাকার যান বন্ধ হওয়ার পর বেশি বিপাকে পড়েন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কারণ, অল্প দূরত্বেই তাঁদের গন্তব্য। প্রতিদিন ওই গন্তব্যে তাঁদের চলাচল করতে হয়। বিকল্প না থাকায় মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে চড়েই তাঁদের চলাচল করতে হয়।

নিমসার জুনাব আলী কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মামুন মিয়া মজুমদার বলেন, ‘মহাসড়কের আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা বেশি বিপাকে আছেন। বিকল্প কোনো বাহন না থাকায় তাঁদের মাইক্রোবাসেই উঠতে হয়। এতে কষ্টের পাশাপাশি ভাড়াও বেশি। তাই মহাসড়কে লোকাল বাস চালু করা দরকার। সেটা হলে জনভোগান্তি কমে আসবে।’