মেয়রের দাবির সত্যতা মেলেনি

বেশির ভাগ অংশেই জমে আছে পানি। আগাছা জন্মেছে। এ জন্য কবর শনাক্ত করার উপায় নেই। গত সোমবার মুরাদপুর কবরস্থানে।  ছবি: প্রথম আলো
বেশির ভাগ অংশেই জমে আছে পানি। আগাছা জন্মেছে। এ জন্য কবর শনাক্ত করার উপায় নেই। গত সোমবার মুরাদপুর কবরস্থানে। ছবি: প্রথম আলো

পূর্ব জুরাইনের মুরাদপুরে কবরস্থানের আধুনিকায়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে বাজেট ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তবে সরেজমিনে দেখা গেল, কবরস্থানটির অবস্থা এতটাই খারাপ যে দেড় বছর ধরে সেখানে কোনো লাশ দাফন করা যাচ্ছে না। সংস্কারকাজ এখনো শুরুই হয়নি। 

গত রোববার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার অনুষ্ঠানে মেয়র সাঈদ খোকন লিখিত বক্তব্যে দাবি করেছেন, মুরাদপুর কবরস্থানের আধুনিকায়নের কাজ সমাপ্তির পথে। তবে গত সোমবার মুরাদপুর কবরস্থান সরেজমিনে দেখা গেছে, কবরস্থানের মূল ফটকে তালা ঝোলানো। কবরস্থানের জায়গাটি বেশ নিচু। ফলে বেশির ভাগ স্থানে পানি জমে আছে। তাতে শেওলা জমেছে। পানির কারণে দু-একটা কবর ছাড়া বাকিগুলোর অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছে না। পুরো কবরস্থানই আগাছায় ভরে গেছে। জংলা পরিবেশ। কবরস্থানের মূল ফটকের দক্ষিণ পাশে একটি জরাজীর্ণ ভবন রয়েছে। দুই ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করেও তদারকির দায়িত্বে থাকা কাউকেই পাওয়া যায়নি। আদৌ কোনো সংস্কারকাজের চিহ্ন নেই কোথাও। অবস্থা এতই বেহাল যে ২০১৮ সাল থেকে এখানে লাশ দাফন বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

কবরস্থানের মূল ফটকে একটি নামফলক লাগানো আছে। তাতে লেখা, স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হামিদ ১৯৪০ সালে ৪২ শতক জায়গা কবরস্থানের জন্য দান করেন। বর্তমানে এটি সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন। তবে এখানে সিটি করপোরেশনের তদারকির কোনো চিহ্ন নেই। 

গত রোববার চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগে লিখিত বক্তব্যে কবরস্থান ও শ্মশানঘাটের উন্নয়ন প্রসঙ্গে সাঈদ খোকন বলেন, আজিমপুর কবরস্থানে আধুনিক ‘মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জামে মসজিদ’ নির্মাণকাজ সম্পন্নের পর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আজিমপুর, জুরাইন ও মুরাদপুর কবরস্থানের আধুনিকায়নের কাজ সমাপ্তির পথে। 

 সোমবার মুরাদপুরের বাসিন্দারা বলেন, জায়গাটি একটু নিচু আর খানাখন্দে ভরা। তাই প্রায় সারা বছরই এখানে পানি জমে থাকে। ফলে এই এলাকায় বসবাসরত কেউ মারা গেলে তাঁকে অন্যত্র দাফন করতে হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কবরস্থানের পাশের এক বাসিন্দা প্রথম আলাকে বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মুরাদপুর কবরস্থানে কোনো সংস্কারকাজ হয়নি। অবস্থা বেহাল দেখে ২০১৭ সালে স্থানীয় সাংসদ সৈয়দ আবু হোসেন ব্যক্তি উদ্যোগে কবরস্থানে মাটি ফেলে উঁচু করতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাছিম মিয়া এই কাজে বাধা দেন। ওই বছর মাত্র দুটি মরদেহ সেখানে সমাহিত করা হয়। ২০১৮ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে মুরাদপুর কবরস্থানের গোসলখানায় গোসল করানো হয়েছিল। তবে কবরস্থানে পানি জমে থাকার কারণে এখানে দাফন করা যায়নি। জুরাইন কবরস্থানে ওই ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত মাসে কবরস্থানের পাশের একটি বাসায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তানহা নামের একটি শিশু মারা যায়। ওই শিশুটিকেও মুরাদপুর কবরস্থানে দাফন করা সম্ভব হয়নি। তাকেও জুরাইনে দাফন করা হয়। 

আজিমপুর, জুরাইন ও মুরাদপুর—এই তিনটি কবরস্থান সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন বলে জানিয়েছে সংস্থাটির সমাজকল্যাণ ও সাংস্কৃতিক বিভাগ। এ ছাড়া দক্ষিণ সিটি এলাকায় ছোট ছোট আরও দুটি কবরস্থানের সন্ধান তারা পেয়েছে। সেগুলো এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বুঝে নেওয়া হয়নি। 

জানা গেছে, এই তিনটি কবরস্থানের মধ্যে আজিমপুর কবরস্থান ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিকায়নের কাজ চলছে। জুরাইন কবরস্থানেও ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিকায়নের কাজ চলমান। চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এই দুটি কবরস্থানের সংস্কারকাজ শেষ হবে। তবে আজিমপুর ও জুরাইনের মতো মুরাদপুর কবরস্থান আধুনিকায়নে কোনো কাজ চলমান নেই। 

ডিএসসিসি সূত্র বলছে, মুরাদপুর কবরস্থানের আয়তন ৪২ শতাংশ। এর সংস্কারে ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে এই কাজের দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া এখনো শুরুই হয়নি। দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু হবে। ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা দিয়ে কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে দোতলা একটা ভবন নির্মাণ করা হবে। সেখানে নিচতলায় মরদেহ গোসল করানোর ব্যবস্থা থাকবে। দোতলায় একটি অফিস কক্ষ, অজুখানা, শৌচাগার এবং ইমামের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া কবরস্থানের চারপাশে সীমানাদেয়াল, মাটি ভরাট করে উঁচু করা, হাঁটাপথ নির্মাণ এবং পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে। 

মুরাদপুর কবরস্থানটি ডিএসসিসির ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। মুরাদপুর কবরস্থানের সংস্কারকাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাছিম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, জুরাইন কবরস্থানের সঙ্গে মুরাদপুর কবরস্থানের সংস্কারকাজে বরাদ্দ আছে। তবে এখনো মুরাদপুর কবরস্থানে কাজ শুরু হয়নি। গত তিন অর্থবছরে কবরস্থান সংস্কার ও উন্নয়ন খাতে সিটি করপোরেশন ৪৮ কোটি টাকা খরচ করেছে। গত তিন বছরে মুরাদপুর কবরস্থানের কোনো সংস্কারকাজ হয়েছে কি না—এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে কিছুই বুঝতে পারছেন না বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। 

বাজেট বক্তৃতায় মুরাদপুর কবরস্থানের আধুনিকায়নের কাজ সমাপ্তির পথে—ডিএসসির মেয়রের এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি। 

তবে ডিএসসিসির সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা আফজালুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, জুরাইন কবরস্থানের কাজ শেষ হলে মুরাদপুর কবরস্থানের কাজ শুরু হবে। কবরস্থানটি নিচু জায়গায় উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, বর্ষা মৌসুম শুরুর পর সেখানে লাশ দাফন হচ্ছে না।